আয়নায় নিজের মুখ-২

একে একে নাম বলে যায় সবাই, জোসেফ, জন, স্ফিভ, জাস্তিন, ইউসুফ, মাহমুদা শীরিন (বাঙালি দোভাষী), রহমান (পাশে বসা বাংলাদেশি ভদ্রলোক), হেইম্যান, লিউ, চ্যান, রাজা—এভাবে ঘরভর্তি একে একে ২২ জন। দুজন দোভাষী আর দুজন নারী প্রশিক্ষক। ঘড়ির কাঁটা সকাল ১০টায়। বসে আছি টরন্টো ফ্যামিলি সাপোর্ট সার্ভিস অফিসের (পার্টনার এসাল্ট রেসপন্স) প্রোগ্রামে। অথচ মাত্র দুদিন আগেও জানতাম আজ এ শনিবার (১৭ অক্টোবর) এ মুহূর্তে আমার দাঁড়িয়ে থাকার কথা টিটিসির লরেন্স স্টেশনে ভোর পাচটা থেকে। কিন্তু মাত্র দুই মিনিটের ফোন কল পেয়ে বদলে যায় রুটিন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি কয়েক মিনিটেই। হোক কিছু কম ডলার জীবনে, তবু ছয় ঘণ্টায় টিটিসির কাজে দাঁড়িয়ে যা পাব, তা যদি দোভাষীর কাজে মাত্র দুই ঘণ্টায় আসে, তা–ই সই। হ্যাঁ, বাড়তি উপার্জন আমার লাগবে কিন্তু সেটার জন্য তাড়াহুড়া করব না।

এর নাম মনে হয় জীবন, তাই না? আমরা হিসাব মেলাতে থাকি ক্রমাগত, জাগতিক হিসাব। আর সেই দোলাচলে পড়ে আমাদের এই মহামূল্যবান এই পরম পাওয়া একটাই জীবন বয়ে যায়। শেষ বেলায় এসে আমরা সবাই নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিই, নিজেকে প্রশ্ন করি, হিসাব কি মিলল? হতবিহ্বল হয়ে যাই নিজের কাছেই, বারবার ঘুরে ঘুরে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়াই কোথায় আমি? কী করছি আমি? কী করতে চেয়েছিলাম এই জীবনে? শুধু ফাঁকা প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মানুষ। কি অদ্ভুত সব মানুষ আমরা?

দিন শুরু হয়েছে আর আগে, ছুটির দিনে সকাল আটটায় পৌঁছে যাই গুড লাইফ ফিটনেস সেন্টারে। ব্যায়াম করে দিন শুরু করব, তাতে শরীরে প্রাণশক্তি পাওয়া যায়। ফাঁকা শহর কিন্তু সেন্টারে পৌঁছে দেখি সেখানেও হাজির হয়েছেন প্রায় ২৭ জন নারী, ২ জন মাত্র পুরুষ। শনিবার তাই জুম্বা ক্লাস হবে, শরীরের প্রতিটা পেশি নড়ে উঠবে, এমন নাচের ভেতর দিয়ে যে গ্রুপ ব্যায়াম ক্লাস করানো হয়, তা–ই জুম্বা। অবাক হয়ে ভাবি, এত বিচিত্রভাবে মানুষ জীবন যাপন করে?

একটা কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে এক ঘণ্টা দেহের যা অঙ্গভঙ্গি করে, সেটা রপ্ত করতে হয়তো আমার আরও দুই জীবন লাগবে। তবু এই যে সারা পৃথিবীর এতগুলো মানুষের সঙ্গে শামিল হয়ে একটা কাজে অংশগ্রহণ করতে পারছি, এই যে এই ৫০ বছর বয়সেও সক্রিয় থাকতে পারছি, কাজ করতে পারছি সপ্তাহে সাত দিন, কোন রোগ এখনো শরীরে বাসা বাঁধেনি—এই ভাগ্যই বা কয়জনের আছে? জুম্বা ক্লাস শেষ করে একদম ঘড়ি ধরে পৌঁছে যাই দোভাষীর কাজে।

বেশ শীত পড়েছে, গত রাতেই কাপড় রেডি করে রেখেছিলাম, ভারী জ্যাকেট খুলে আরাম করে সেশনে বসি। ২২ জন মানুষ একটা মাঝারি সাইজের হল রুমে। সবাই একই রকম অপরাধ করেছে, সারা পৃথিবীর ১৯ জন মানুষের ভেতরে মাত্র একজন বাংলাদেশি, রহমান ভাই মধ্যবয়সী মানুষ। এ দেশে আছেন আড়াই বছরের ওপরে। দুটো অড জব করে জীবন চালান, সেই হতাশা থেকেই কি পরিবারে অশান্তি? আমার কাছে কোনো ক্লু নেই, যেমন ক্লু নেই বাকি ১৮ জন পরিবারে বা নিজের পার্টনারের সঙ্গে কি অপরাধ করেছেন। আগামী সাত দিনের সেশনের ভেতর দিয়ে সবাইকে একটা হেলথি রিলেশনের ভালো-মন্দ দিকের খুঁটিনাটি বোঝানো হবে। আর রহমান ভাইকে বাংলায় সেশন বুঝতে আমি সহযোগিতা করব। প্রায় আট বছরের দোভাষীর কাজে আমি এমন পাড় সেশন করেছি মোট চার-পাঁচটা, সবই ছেলেদের, মাত্র একটা মেয়েদের সেশন।

সময় অনেক অনেক বেশি আধুনিক হয়ে গেছে, সেটা বুঝতে পারি নিশিন্তভাবেই। কিন্তু কিছু বিষয় কি আধুনিক হয়েছে? সেশনে বসে রহমান ভাইকে সাপোর্ট করার চেয়েও অনেক অনেক বেশি কথা বলি নিজের সঙ্গে। নিজের জীবনের সঙ্গে, রিভিউ করি নিজেকেই। মনে পড়ছে, একবার একজন প্রশ্ন করেছিল আমাকে, কি চান আপনি একজন স্বামীর কাছে? উত্তর দিয়েছলাম, শুধু সৎ মানুষ চাই। তিনি আবার বলেছিলেন, ভেবে বলেছেন? আমি বলি, হ্যাঁ বলেছি। তিনি আবার বলেন, ভাবুন তো আপনার স্বামী সৎ কিন্তু মুখে ভীষণ দুর্গন্ধ। অনেক পড়াশোনা করেছেন কিন্তু ম্যানার জানেন না, অনেক সৎ, তাই ভালো রোজগার নেই। এদিকে আপনার সংসারের টাকা দিয়ে চালাতে হবে আপনার শ্বশুরবাড়ির কয়েক ডজন মানুষকে। আপনার স্বামী সৎ কিন্তু মেয়েদের কাজ চাকরি করা পছন্দ করেন না। আপনার স্বামী ভীষণ সৎ কিন্তু তিনি আপনার সঙ্গে ভালো করে শারীরিক সম্পর্ক করতে জানেন না, তিনি জানেন না আপনাকে কী করে সুখী করা যায়—পারবেন এই সততা বহন করতে আজন্ম? আমি কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিয়াল সেদিন, হুট করে মুখে কথা সরেনি।

আজ এই সেশনে বসে একজন সাদা ছেলে যখন বলছেন গুড সেক্স মানেই হেলথি রিলেশন। সঙ্গে সঙ্গেই প্রশিক্ষক বলে ওঠেন, গ্রেট সেক্সের সঙ্গে আর কী কী জড়িয়ে থাকে? তখন সবার মুখ থেকে একে একে উত্তর আসে, ওনেস্টি, মিউচুয়াল শেয়ারিং, মিউচুয়াল রেসপেক্ট, কেয়ার ফর ইচ আদার ,মিউচুয়াল বিলিভ, অ্যাকাউন্টিবিলিটি, হেলদি রিলেশনের প্রতিটা পিস প্রতিটা পুরুষ জানেন। কিন্তু আজ যাঁরা এই সেশনে বসে আছেন, তাঁরা সবাই নিজেদের পার্টনারকে এসল্ট করেছেন বা নির্যাতন করেছেন।

জীবন এমনি এক গোলচক্র, বারবার নিজেকেই শুধু বদলাতে বলে। বারবার সচেতন মানুষকে নিজের দিকেই আঙুল তুলতে হয়। বেশ ভালো লাগে একটা কৃষ্ণাঙ্গ ছেলের কমেন্ট শুনে। যখন প্রশ্ন করা হয়, আসলে রিলেশনে মূল সমস্যা কোথায়? বোঝা যায় ৪৩ থেকে ৪৪ বছর বয়সী এই পুরুষ ইতিমধ্য এ জীবনের ব্যাপারে যথেষ্ট নেতিবাচক হয়ে উঠেছেন। জীবনের অনেক নোংরা দিক দেখে ফেলেছেন। ফোঁস করে বলে উঠলেন, আসলে প্রেমিকা বা পার্টটাইম গার্লফ্রেন্ড সব ঠিক আছে, শুধু মেয়েদের ব্যাপারে সমস্যা হয়ে যায় তখনই, যখন তাকে আংটি পরানো হয়। তখনই মেয়েরা রিলেশনকে ওন করতে শুরু করে, রিলেশনের ভেতরে কোনো স্পেস দিতে চায় না।

হুট করে চুপ হয়ে যাই, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় আমার। কারণ, কথাটা ভীষণ সত্যি। আজও পৃথিবীর সব মেয়ে সংসার করতে চায়, সংসার বাঁচাতে চায় ১০০ ভাগ চেষ্টা দিয়ে। কালো, সাদা, নীল, হলুদ, কমলা—সব রঙের, সব বর্ণের মেয়েরা সংসারের বন্ধনে আটকে যেতে ভালোবাসে। তাই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সুন্দরী লেডি ডায়না, যিনি জানতেন তাঁর স্বামী প্রিন্স চার্লস বিয়ের আগেই অন্য নারীতে আসক্ত, তবু সংসার ছেড়ে যান না ডায়না। বিপুল ক্ষমতাশালী হিলারিও ক্লিনটনের নোংরামি সয়ে যান বিনা দ্বিধায়।

সেশনে বসে অন্য একটা কথা মনে পড়ল। বাংলাদেশে নাকি বিবাহবিচ্ছেদের হার ভীষণ বেড়ে গেছে। আমি ভাবি কতটা বেড়েছে? একজন বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষক বলেছিলেন ২০০০ সালে, যে বছর আমি নাইয়ার বাবার সঙ্গে আলাদা হয়েছিলাম। স্যার বললেন, শোন লুনা, যে সমাজে বিচ্ছেদের হার যত বাড়বে, সেই সমাজে নারী নির্যাতন তত কমে আসবে। আমি অনেক ভেবেছি কথাটা, হার বাড়া বা কমা নিয়ে আমার ভাবনা না। আমি শুধু যেকোনো সম্পর্কে একটা জিনিস দেখতে চাই, নারী-পুরুষ কতটা স্ব– ইচ্ছায় এই সম্পর্ককে টেনে নিচ্ছেন? দিনে দিনে সম্পর্ক কি তাদের কাছে বোঝা হয় নাকি প্রতিদিন মনে হয়, আহা, আরও কিছুদিন এই ভালোবাসার জীবনটা যাপন করতে পারতাম? এই তৃষ্ণা কি সম্পর্কের ভেতরে থাকে? যদি সেটাই থাকে, তাহলে কেন স্বামী বা স্ত্রীকে বারবার বলতে হবে, তুমি কেন নেটে বসো? তুমি কেন আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও বেশি সময় দাও? বারবার ফেসবুকে মুখে রং মেখে ছবি দিয়ে প্রমাণ করতে হবে—এই দেখো আমরা ভালো আছি। ঠিকভাবে সংসার করলে বা একজন মানুষের সঙ্গে সৎভাবে জীবন যাপন করলে তো ফেসবুকে বা অন্য কাজে সময়ই পাওয়ার কথা না, তাই না? এসব ইস্যু নিয়ে তো কথা বলারই দরকার নেই। আমি তো আমার ভালোবাসার তাগিদেই বারবার প্রিয় মানুষের কাছে আসব, জোর করে বা সেশনে বসে শিখে/পড়ে জীবন হয়তো যাপন করা যায়। ভালোবাসার সেই আনন্দ কি শিখে-পড়ে হয়?

কয়টা মেয়ে আনন্দের সঙ্গে, জোরের সঙ্গে, বিশ্বাসের সঙ্গে বলছে, হ্যাঁ, আমার সংসারে দুঃখ–কষ্ট আছে, আমার সংসারে ভাত-কাপড়ের অভাব আছে কিন্তু আমার সংসারে ভালোবাসার অভাব নেই। আমরা দুজনেই প্রতিদিন ভালোবেসে ঘুম থেকে জেগে আরও একটা দিন পার করব বলে প্রস্তুতি নেই।

আজকের সেশনে আর বলা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে দুজন মানুষ একসঙ্গে সুখী থাকা যতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা কমিউনিকেশন বাড়ুক না কেন, মানুষকে বিশ্বাসী হতে হবে, সৎ হতে হবে। এই পথের বিকল্প কোনো পথ বের হয়নি আজও।

ভাবনার জাল আমার মনের গহিনে ঘুরপাক খেতে থাকে। সততার সংজ্ঞাও কি ভিন্ন ভিন্ন নাকি একটাই সংজ্ঞা?