মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা-৬

মা যেন মুরগির বাচ্চার মতো আগলে রাখত আমায়।

মাকে নিয়ে যুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মনে পড়ল, সেই সময় বাড়িতে কেউ ছাই ফেলে কুলা পরিষ্কার করার জন্য কোনো গাছের সঙ্গে বা মাটিতে কুলা বাড়ি দিয়ে পরিষ্কারের সময় যে শব্দ হতো, এতে বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে যেত। মা সেই শব্দ শুনে এমনভাবে দৌড়ে এসে আমাদের সতর্ক করতেন, যেন সমূহ বিপদ ঘনিয়ে আসছে সামনে। যখন পরিষ্কার হতো শত্রুপক্ষের কোনো অস্ত্র বা অন্য কোনো কিছুর শব্দ নয়, তখন নিরাপদ মনে করে মা পুনরায় চলে যেত তার নির্ধারিত কাজে।

মনে পড়ে, একবার দুপুরের সময় বাড়ির দক্ষিণ দিকে এলাকার সব যুবক–বৃদ্ধ লাঠি, শাবল, কুড়াল নিয়ে রেল উপড়ে ফেলতে গেল হই হই করে। ট্রেন যেন ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে, এ জন্য রেললাইন উপড়ে ফেলে পুনরায় ফিরেও এল এলাকায়। অনেকেই ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে ঘটনার কথা ব্যাখ্যা করছিল। সেই ঘটনার সময় অস্ত্রবাহী রেলগাড়ি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী যাচ্ছিল। আগেই সংবাদ পেয়ে সেই ট্রেন আটকানোর জন্য এই কাণ্ড ঘটানো। এর কিছু সময় পর ঢাকা থেকে অন্য ট্রেনে রেলশ্রমিক এবং মিস্ত্রি এসে সঙ্গে সঙ্গে রেল ঠিক করে সেই অস্ত্রবাহী রেলগাড়ি ঢাকা নিয়ে নিয়ে যায়। এরপর যতটা মনে পড়ছে, পরের দিন দুপুরের আগেই হঠাৎ করে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে এবং হেলিকপ্টারে ওপর থেকে সমানে আমাদের এলাকার ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। মা সেদিন এ ঘটনার সময় দৌড়ে এসে আমাদের ঘরের পাশে উঁচু ভিটার সঙ্গে এমনভাবে সেঁটে বসিয়ে রেখেছিল, যেন কোনোভাবে গুলি এসে আমাদের গায়ে না লাগতে পারে।

এরপর আরও একদিনের কথা মনে পড়ছে।

বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যখন দূরে নিরাপদ আশ্রয় নিই, তখন এক বাড়িতে স্থান সংকুলানের কারণে আমাদের বাড়ির বিভিন্ন পরিবার আলাদা হয়ে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে থাকি। একদিন দুপুরে খাবার পর কাকা–কাকিমা যে পরিবারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর কাকা–কাকিমারা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই বাড়ির প্রায় কাছাকাছি যাওয়ার পর হঠাৎ করেই দেখি মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটি যুদ্ধবিমান ওড়াউড়ি করছে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে দেখি আকাশ থেকে কাছেই কোথায় যেন বোম্বিং করছে। কাছে বলতে ঘোড়াশাল এলাকায় ঘটছিল ঘটনাটি। এ ঘটনার সময় সবকিছুই যেন আকাশে দেখতে পাচ্ছিলাম।

মা তা দেখে তাড়াতাড়ি আমাদের উঁচু রাস্তা থেকে টেনে নিচু খেতে নামিয়ে রাস্তার সঙ্গে ঘেঁষে বসিয়ে রাখল। তার ওপর মা এমনভাবে আমাদের আগলে রেখেছিল, যেন কিছু হওয়ার আগে মায়ের ওপর এসে লাগে। মা কোনো কিছুতে আমাদের ক্ষতি হতে দিতে চাইল না। পরিবেশ যখন শান্ত হয়, তখন আমাদের নিয়ে সেই কাকা–কাকিমারা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই বাড়িতে যায়। রাতের আগে আমরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি, সেই বাড়িতে ফিরে যখন ঘটনার বিষয় আলোচনা করছিল। তখন বাড়ির সবাই রেডিওর সংবাদ শুনে নিশ্চিত হয়েছিল যে (সম্ভবত) সেটি ছিল ভুল অ্যাকশন। যেখানে বোম্বিং করা হয়েছিল, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল এবং বোম্বিংও করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারাই। ভুলে ক্যাম্প থেকে কেউ নাকি যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে প্রথম গুলি করে। তার জবাবে ঘটেছিল সেই বোম্বিংয়ের ঘটনা।

এ ছাড়া শীতের দিন আমরা সহায়সম্বল কোনো কিছু না নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম। আমাদের অবস্থা দেখে মানুষ আমাদের যে কাপড় দিয়েছিল, তাতে শীত নিবারণ হতো না। তখন মা অনেক সময় কাঁথা-কম্বল দিয়ে বা মায়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাদের আগলে ধরে শীত থেকে রক্ষা করত।

বিষয়টি এখানে স্মৃতিচারণায় নিয়ে আসার কারণ, মা যখনই কোনো বিপদের গন্ধ পেয়েছে, তখনই আমাদের আগলে ধরে বসে থাকত। বিশেষ করে সমূহ বিপদের আশঙ্কায় মুরগি তার ছোট বাচ্চাদের দুই ডানার নিচে যেভাবে আগলে রাখে, ঠিক তেমনিভাবে মা আমাদের আগলে রাখত। যুদ্ধ এবং মা আমার কাছে সত্যিই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাই উল্লেখ করা।

স্বাধীনতাযুদ্ধ আমার স্মৃতিতে যত দিন থাকবে, তত দিন মাকে সেই স্মৃতি থেকে আলাদা করতে পারি না, পারবও না। চলবে...

আরও পড়ুন