টেনেরিফের বতুতা বাহিনী-৩

সিয়াম পার্কের কৃত্রিম সৈকত। ছবি: সংগৃহীত
সিয়াম পার্কের কৃত্রিম সৈকত। ছবি: সংগৃহীত

৬.

ওয়াটার পার্কের নাম শুনলেই মনে হয় দেয়ালঘেরা বিশাল কোনো জায়গা, যার চিপাচুপায় অনেকগুলো পানির কল বসিয়ে রাখা আছে আর লোকজন তাতেই হুটোপুটি খাচ্ছে। এর মধ্যে বিনোদনের কী আছে। সুতরাং, প্যাঁচামুখ করে ঘুরছি। টেনেরিফের একেবারে উত্তর দিকে সিয়াম পার্ক নামের এই ওয়াটার পার্কে আসতে সময় লেগেছে। বাকিটা দিন মাঠে মারা যাবে মনে হচ্ছে।

আশপাশে নানান বয়সী ছেলে বুড়ো আর বিকিনি সুন্দরীদের ভিড়। এমন নির্মল খোলামেলা পরিবেশে এসে বেশ লাগছে আমাদের দলের জনা দুয়েকের। ছেলের বাবা আর তার সংগত আরকি। তারা আগ্রহ নিয়ে আগে আগে হাঁটছে। আমি আর আদিবা আস্তে ধীরে অলস পা ফেলছি। আজকের দলটা অসম্পূর্ণ। সামান্য সর্দি-গর্মির কারণে ছোট্ট আমালিয়াকে তার বাবার জিম্মায় রেখে আসতে হয়েছে। আদিবা তাই ঝাড়া হাত-পা। কিন্তু তার কপালে দুটো ভাঁজ। ছানা রেখে এসে ঠিক স্বস্তি লাগছে না।

দলের একমাত্র শিশু তাফসু মিয়াকে দলপতি বানিয়ে তার আজ্ঞায় বাকিরা চললাম পিছু পিছু। খানিকক্ষণের ভেতরেই সে তার মর্জিমতো ভিজে ভূত হয়ে একটা ভেজা তোয়ালের মতো হয়ে গেল। হাত চাপলেই পানি ঝরছে। তবুও থামাথামি নেই। তার ইশারায় এবার যেতে হলো সৈকতের দিকটায়। একটা হোঁচটের মতো খেলাম। এ যে দেখি কৃত্রিম বানিয়ে রাখা সিমেন্টের সৈকত। টেনেরিফের অমন দারুণ বিচ রেখে লোকে এখানে ভিড় করছে কেন, মাথায় ঢুকল না।

লোকের চিন্তা বাদ দিয়ে আরেক চিন্তা এসে ভর করেছে। বিশাল ঢেউ পাল তুলে হঠাৎ তেড়ে আসছে। মানুষজন আতঙ্কে চিৎকার করছে রীতিমতো। এদের পানির কল ফেটে ফুটে গেল নাকি? নইলে এমন সুইমিং পুল মার্কা জায়গায় ঢেউ আসবে কোত্থেকে? মুহূর্তের মধ্যে বাবা-ছেলে বরাবর দৌড় লাগালাম। এদের কেউই সাঁতার জানে না। বড় একটা ছাতার ছায়ায় আধশোয়া আদিবা কিচিরমিচির করে কী যেন বলছে। কিছুই ভালো করে কান অবধি পৌঁছাল না।

বাঁ থেকে আদিবা, লেখিকা, শিশুসদস্য ও তার বাবা। ছবি: আদিবা আমাথ
বাঁ থেকে আদিবা, লেখিকা, শিশুসদস্য ও তার বাবা। ছবি: আদিবা আমাথ

বারো হাত কাকুরের তেরোর হাত বিচির মতো হাঁটুপানির নকল সৈকতে ঘাড়সমান ঢেউটা আছড়ে পড়ে এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলে দিল। পুরোপুরি হতভম্ব, তবে আশ্বস্ত চোখে দেখলাম সাঁতার না জানা দুজন দিব্যি একজন আরেকজনের কাঁধে আকর্ণ হাসি নিয়ে বসে আছে। তাদেরকে হাঁটুপানির জলদস্যুর মতোই দুর্ধর্ষ লাগছে।

‘ঢেউটা তো একটা খেলা। অ্যাডভেঞ্চার ভাব আনার জন্য একটু পরপর এরা পানির একটা তোড় ছাড়ে। আসতে আসতে খেয়াল করেননি? বাই দ্য ওয়ে, দৌড়টা কিন্তু সে রকম খিঁচে দিয়েছেন, হাহাহা...। ’ আদিবার একটু আগের কিচিরমিচিরের অর্থ বুঝলাম এতক্ষণে।

৭.
বাকিটা বেলার পুরোটা জলে-ডাঙায় কাটিয়ে যখন ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দলের বাকি সদস্য আমালিয়া আর তার বাবা আকরাম এসে জুটেছে সঙ্গে। বসেছি সেই গতকালের কাঁচা পেঁপের আলপাকা রঙের চেয়ার-টেবিলেই। তবে আজকের আয়োজন অন্য রকম। মঞ্চের মতো বাঁধা হয়েছে রেস্তোরাঁর পেছনের ফাঁকা জায়গাটায়। আলো-আঁধারের ঝাপসা পরিবেশ বদলে গিয়ে ব্লুমের ঝকমকে ঝালর ঝুলছে মঞ্চের ওপাশে।

হেতুটা স্পষ্ট হতে সময় লাগল না। ফ্লামিঙ্গো নাচ হবে এখন। পুরু করে মোজ্জারেলা দেওয়া পিজ্জা আর রোজমেরির ঘ্রাণে ভুরু ভুর মাশরুম-পাস্তার থালা ঠেলে উঠে গেলাম। একটা সম্মোহন কাজ করছে। আঁটোসাঁটো নকশাকাটা পোশাকে চওড়া কাঁধের দুজন ভীষণ সুপুরুষের বিপরীতে টকটকে লাল গাউনে দুই অপ্সরী এগিয়ে এল। তাদের ব্লক হিল শু অদ্ভুত সুরে তাল তুলেছে। স্প্যানিশ গিটারের সঙ্গে জুতার ঠকঠক যেন সংগতের কাজ করছে। সেতারের সঙ্গে যেমন তবলা।

ফ্লামিঙ্গো নাচ। ছবি: সংগৃহীত
ফ্লামিঙ্গো নাচ। ছবি: সংগৃহীত

ভাবছি, পায়ের জুতা কি হাতের গিটার, সবই তো নিষ্প্রাণ কাঠের। তাদের জুড়ি কী করে এমন জ্যান্ত, প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। তালে তালে মরাল গ্রীবা বাঁকিয়ে মোহনীয় মুদ্রায় লাল গাউনের নাচিয়েদের ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া বলে ভুল হচ্ছে। এই তাহলে ফ্লামিঙ্গো নাচ। টেবিলের থালাগুলো জুড়িয়ে যেতে দিয়ে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হারিয়ে গেলাম সুর-তাল-লয়ের প্রলয়ে।

কড়া হাততালি দিয়ে নাচের পালার ইতি টানা হলো। আমরাও খাবারগুলোর কাছে ফিরে এলাম। ঠান্ডা পিজ্জা টান দিতেই চুইংগামের মতো লম্বা হতে লাগল। তা-ই গোগ্রাসে চিবিয়ে গিলে ক্ষুধার্ত পেটে পাঠিয়ে দিলাম।

বাক্স-পেটারা গুছিয়ে নাচিয়ের দলটা বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যস্ত সমস্ত ভাব। কৌতূহলী আড়চোখে তাদের ব্যস্ততা দেখছি। একজন নর্তকীকে দাঁতের পাটি খুলে ছোট্ট একটা বাক্সে পুরে নিতে দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। আরেকজন ঘন কালো পরচুলা খুলে ভাঁজ করছে। চেপ্টে থাকা পাতলা ফিনফিনে চুল ঘেমে লেপ্টে একাকার। পুরুষদের একজন কন্টাক্ট লেন্স খুলে মোটা ফ্রেমের চশমা এঁটেছে নাকের ডগায়। পৌরুষদীপ্ত ভাবটা উবে গিয়ে তাকে স্কুলের মাস্টার মশাই লাগছে রীতিমতো। সাজসজ্জার সঙ্গে একটু আগের দারুণ শোম্যানশিপও স্যুটকেসে পুরে নিল চারজনের দলটা। ঢোলা টি-শার্ট আর ভুশভুশে জিনসে নয়-পাঁচটা চাকুরের মতো হদ্দ ক্লান্ত হয়ে বিদায় নিল তারা। কে জানে আরেক রেস্তোরাঁয় গিয়ে নাচতে হবে কি না আবার। বিচিত্র অথচ বাস্তব এক অনুভূতিতে মন ছেয়ে গেল। (চলবে...)

*লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি