আলবেনিয়ার ডায়েরি-তৃতীয় পর্ব

রোজাফা ক্যাসেল। ছবি: লেখক
রোজাফা ক্যাসেল। ছবি: লেখক

বাংকারের পাশাপাশি আলবেনিয়া বিভিন্ন ধরনের ক্যাসেল কিংবা দুর্গের জন্য বিখ্যাত। দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু ক্যাসেল বা দুর্গ। এদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ক্যাসেল হচ্ছে দুরেস ক্যাসেল, ক্রুয়ে, রোজাফা ক্যাসেল, ক্যাসেল অব জিরোকাস্ট্রা, লেকুরসি ক্যাসেল, বোরস ক্যাসেল, বেরাত ক্যাসেল।

আমার কাছে রোজাফা এবং বেরাত ক্যাসেলকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। বেরাতের ক্যাসেলটি বাইজেনটাইন শাসন আমলে নির্মিত। বিভিন্ন সময়ে যে সকল সাম্রাজ্যের শাসকেরা আলবেনিয়া শাসন করেছেন যাদের সবাই স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন এ ক্যাসেলটির মাঝে। অটোমান শাসকেরা এ ক্যাসেলটিকে তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলেন। বেরাতকে তারা আলবেনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করেন। পাশাপাশি ক্যাসেলটির ভেতরে তারা দুটি মসজিদ নির্মাণ করেন। অটোমান শাসন আমলে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতেন। ক্যাসেলের ভেতর যেমন মসজিদ রয়েছে, ঠিক তেমনি চার্চও রয়েছে।

অটোমান শাসকেরা বেরাত শহরটির আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বেরাতের বেশির ভাগ স্থাপনা এমনকি ঘরবাড়িগুলো অটোমানদের স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত। পর্যটন কেন্দ্রের পাশাপাশি এ ক্যাসেলে মানুষেরও বসবাস রয়েছে। বলা হয়ে থাকে এদের অনেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে এ ক্যাসেলটিতে বাস করে আসছেন। বলতে গেলে ক্যাসেলের ভেতরের সমস্ত এলাকাটি একটি ভিন্ন সমাজ কাঠামোর পরিচয় বহন করে যেখানে সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে। তবে বলকান যুদ্ধের সময় এ ক্যাসেলটি সার্বিয়ান, বুলগেরিয়ান ও গ্রিকদের আগ্রাসনের শিকার হয়। তারা ক্যাসেলের ভেতর থেকে অটোমানদের স্বাক্ষর বহন করে এমন অনেক নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়।

লেক স্কোদার। ছবি: লেখক
লেক স্কোদার। ছবি: লেখক

বেরাত শহরে ঢুকতেই পাথরের তৈরি একটি ব্রিজ চোখে ধরা দেবে। ব্রিজটি অটোমান আমলে নির্মিত। স্থানীয়রা এ ব্রিজটিকে গোরিছা ব্রিজ বলেন। অসুম নদীর ওপর নির্মিত পাথরের তৈরি এ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে এক পাশ থেকে ক্যাসেল এবং অন্যপাশ থেকে অটোমান স্থাপত্যকলার আদলে নির্মিত বেরাতের ছোট ঘরগুলোর অসাধারণ সৌন্দর্যের অবলোকন করা যায়। বেরাত থেকে ফেরার পথে আমাদের সঙ্গে এক আলবেনীয় পরিবারের পরিচয় হয়। তারাও আমাদের বিভিন্নভাবে আপ্যায়ন করেছে। বেরাত থেকে তিরানা যাওয়ার আমাদের (তিনজন) বাস ভাড়া তারা পরিশোধ করেছে। আলবেনিয়া অর্থনৈতিকভাবে যত দুর্বল হোক না কেনও, আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার দিক থেকে এদের জুড়ি মেলা ভার। বিদেশি পর্যটকদের তারা সম্মানের চোখে দেখে।

স্কোদার মূলত মন্টেনেগ্রোর সীমান্তবর্তী একটি শহর। বলকান অঞ্চলের প্রকৃত সৌন্দর্যে দেখতে স্কোদারে আসতে হবে। বুনা এবং ড্রিন দুই নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত রোজাফা ক্যাসেলটি সত্যি মানুষের সৃষ্ট স্থাপত্যশৈলীর অসাধারণ নিদর্শন। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের জন্য বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে লেক স্কোদার, তবে আলবেনিয়াতে একটি সমস্যা আমার চোখে ধরা দিয়েছে। এ ছাড়া আরও একটি উল্লেখ করার মতো ক্যাসেল হচ্ছে ক্রুয়ে। রিনাসে দেশটির একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এটি খুব কাছে। ক্রুয়ের এ ক্যাসেলটি নির্মাণ করা হয় আনুমানিক ১৪৩২ থেকে ১৪৩৭ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়। মূলত সে সময় অটোমান শাসকদের বিরুদ্ধে আলবেনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনকে ঘিরে ক্যাসেলটির নির্মাণ করা হয় যদিও আলবেনিয়ার সে সময়কার স্বাধীনতা আন্দোলন আলোর মুখ দেখে নি। তবে আমার কাছে ক্রুয়ের ক্যাসেলটি তেমন একটা ভালো লাগে নি। এটা শুধু আলবেনিয়াতে নয়, বলকান বেশির ভাগ দেশের চিত্র এ রকম। আর সেটি হচ্ছে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে খুব বেশি একটা সচেতন নয়। মানুষজন যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে পরিবেশকে দূষণ করে যা এক কথায় হতাশাজনক। পাশাপাশি আলবেনিয়ার গণপরিবহন ব্যবস্থাও খুব বেশি একটা আশাব্যঞ্জক নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষজন আলবেনিয়ার অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে ছোট মিনিবাস বা মাইক্রোবাস ব্যবহার করে তবে আলবেনিয়াতে এখনো ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম খরচে ভ্রমণ করা যায়।

আলবেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভ্লোরে নামক একটি শহর রয়েছে, দুরেসের মতো ভ্লোরেও আলবেনিয়ার আরও একটি বন্দর শহর। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে ভ্লোরে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। বিশেষ করে ভ্লোরে থেকে সামান্য ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে সারেন্ডা নামক স্থানে ‘ব্লু আই’ নামক একটি প্রস্রবণ রয়েছে। ‘ব্লু আই’ এ পৃথিবীর সবচেয়ে স্বচ্ছ পানির প্রস্রবণগুলোর মধ্যে একটি। আলবেনিয়ানদের চোখে ব্লু আই হচ্ছে একটি অনন্য ভূ-স্বৈর্গিক নিদর্শন যদিও আমরা যে সময় ব্লু আই ভ্রমণে গিয়েছিলাম সে সময়টি ছিলও শীতের সময় এবং এ কারণে ব্লু আইয়ের প্রকৃত সৌন্দর্যের স্বাদ পাওয়াটা সম্ভব হয়নি।

আলবেনিয়াসহ বলকান অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার বুরেক। ছবি: লেখক
আলবেনিয়াসহ বলকান অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার বুরেক। ছবি: লেখক

আলবেনিয়া ১৯১১ কিংবা ১৯১২ সালের দিকে স্বাধীনতা লাভ করে প্রথম বলকান যুদ্ধের পর। আলবেনীয় ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ সার্বিয়া, মেসেডোনিয়া ও গ্রিসের দখলে চলে যায়। ফলে আলবেনিয়ার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে পড়ে যায়। আলবেনিয়ানদের খাদ্যাভ্যাস বলতে গেলে পুরোটাই তুর্কিদের মতো। তবে তুর্কিদের মতো তারা রান্নায় তেমন একটা মসলা ব্যবহার করে না। অন্যান্য বলকান দেশগুলোর মতো আলবেনিয়াতে বুরেক জনপ্রিয় একটি খাদ্য উপাদান। বুরেক হচ্ছে এক ধরনের বেক করা খাবার যেটি মূলত ময়দার সহযোগে তৈরি করা হয়, তবে ভেতরে ফিলিং তৈরি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পনির কিংবা মাংসের কিমা অথবা আলু ও পালংশাক ব্যবহার করা হয়।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মাদার তেরেসা জাতিগতভাবে একজন আলবেনিয়ান। তবে তাঁর জন্ম বর্তমান মেসিডোনিয়ান রাজধানী স্কোপিয়াতে। আলবেনিয়ায় জাতিসত্তায় মাদার তেরেসা একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

‘Besa’ এ শব্দটি আলবেনিয়ানদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরিভাবে এ শব্দের বাংলা অনুবাদ না করা গেলেও ভাবগত দিক থেকে বলা যায় এ শব্দটি মূলত শপথনামাকে ইঙ্গিত করে। কাউকে যদি তারা কোনোও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সময় কোনোও আলবেনিয়ান যদি এ ‘Besa’ শব্দটি ব্যবহার করে তাহলে যত প্রতিকূলতা আসুক তিনি তার জীবন দিয়ে হলেও তার সে প্রতিশ্রুতিটি রক্ষা করবেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলবেনিয়া যৌথভাবে জার্মানি ও ইতালির আগ্রাসনের শিকার হয়। কিন্তু দেশটির সাধারণ মানুষ সে সময় আলবেনিয়াতে আশ্রয় নেওয়া ইহুদিদের কোনোভাবে নাৎসিদের হাতে তুলে দেয়নি। নিজেরা শত প্রতিকূলতার মাঝেও তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কেননা সে সময় গোটা আলবেনিয়ার মানুষ এ এক শব্দে তাদের নিকট প্রতিজ্ঞা করেছিল যে আর যা-ই হোক কোনোভাবে তারা ইহুদিদের নাৎসিদের হাতে তুলে দেবেন না।

আলবেনিয়ার অধ্যায়টি আমার জীবনে বিশেষ একটি অধ্যায়। প্রায় ছয় সপ্তাহ একটি দেশে থাকার পর সেই দেশটির প্রতি আলাদা এক ধরনের ভালোবাসা জন্মেছিল আমার মাঝে। বিশেষত যে স্কুলে আমি কাজ করতাম সেখানকার ছোট বাচ্চাদের প্রতি সব সময় আমার এক ধরনের পিছুটান কাজ করত। এ ছাড়াও ওই স্কুলে কাজ করা অন্যান্য স্টাফ ও শিক্ষকের সঙ্গেও আলাদা একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে অর্নেলা নামক একজন মাঝারি বয়সের নারী, যিনি স্কুলের শিক্ষক। অর্নেলাও খুব বেশি ইংরেজিতে পারদর্শী ছিলেন না তবে আমার সঙ্গে তার বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমাকে দেখলেই শুধু দুইটা আলবেনিয়ান শব্দ উচ্চারণ করত, ‘Pellikori’ এবং ‘Mortja qe ste ha’। এ দুইটি শব্দের অর্থ আমি এখন পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারিনি। গুগল ট্রান্সলেট থেকেও এ দুইটি শব্দের অর্থ খুঁজে বের করতে পারিনি। পাশাপাশি অন্যান্য আমার যে সকল সহকর্মী ছিলেন যারা এ প্রজেক্টে আমার সঙ্গে কাজ করেছেন বিশেষত নাদিয়া, এলিফ এবং খাই লি সবাইকে নিয়ে একটা পরিবারের মতো আবহ করে উঠেছিল।

পেলাম্বাসের হাইকিং শেষে লেখক। ছবি: লেখক
পেলাম্বাসের হাইকিং শেষে লেখক। ছবি: লেখক

ইউরোপে পা রাখার পর এটি ছিল আমার প্রথম কোনোও ভ্রমণের গল্প। আলবেনিয়া থেকে অনেক কিছুর স্বাদ নিয়েছি যেগুলো বলতে গেলে জীবনে অনেক ক্ষেত্রে ছিল প্রথম। দাইতি আলবেনিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং সমগ্র আলবেনিয়ার মধ্যে একমাত্র এ দাইতি পর্বতমালার চূড়ায় শীতে তুষারপাত দেখা যায়। জীবনে প্রথম ক্যাবল কার রাইডের অভিজ্ঞতা পেয়েছি দাইতি ঘুরতে এসে। এ ছাড়া যে প্রজেক্টে আমি কাজ করতাম আমার সঙ্গে আর্নল্ড নামক একটা ছেলে কাজ করত, আর্নল্ড মূলত ছিল আমার মেন্টর। আলবেনিয়াতে যাবতীয় বিষয় সে দেখাশোনা করত, কোথাও কোনোও সমস্যার সম্মুখীন হলে কিংবা কোনোও কিছুর প্রয়োজন হলে আমার হয়ে সে সকল কিছু সমাধানের চেষ্টা করত। আইজেকের অধীনে আরও কিছু প্রজেক্ট ছিল আলবেনিয়াতে, পরবর্তীতে সব প্রজেক্টের অন্যান্য ভলান্টিয়ার ও মেন্টরদের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। জীবনে প্রথম হাইকিংয়ের স্বাদও পেয়েছিলাম আলবেনিয়াতে এসে, পেলাম্বাস নামক ছোট একটি গ্রাম রয়েছে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানা থেকে একটু দূরে। পেলাম্বাসে একটি গুহা এবং একটি জলপ্রপাত রয়েছে, এ জলপ্রপাত থেকে আলবেনিয়ার অন্যতম একটি প্রধান নদীর গতিপথ সূচিত হয়েছে। নদীটির নাম অবশ্য মনে নেই তবে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয় এবং কোনোও কোনোও ক্ষেত্রে এ পথের কিছুটা জায়গা অনেকটা বিপজ্জনক যেখানে একটা সামান্য অসচেতনতা বড় কোনো বিপদের কারণ হতে পারে। পেলাম্বাস ছিল আমার জীবনের প্রথম হাইকিং অভিজ্ঞতা।

জীবনের অনেক প্রথম অর্জিত হয়েছে এ আলবেনিয়াকে ঘিরে, এমনকি প্রথম কোনোও নারীর থেকে ভালোবাসার প্রস্তাব পেয়েছিলাম আলবেনিয়া এসে। স্কোদার যাওয়ার সময় বাসে আমার সঙ্গে এক মেয়ের পরিচয় হয়। সে পাশের সিটে বসেছিল। যাত্রাপথে বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়, যদিও সে ইংরেজিতে পারদর্শী নয় তবে গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করেই আমরা আলাপচারিতা সম্পন্ন করছিলাম। মেয়েটির নাম ছিল আদেলিনা পারদোদা এবং সে স্কোদারের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক করেছে। আমাকে তার ভালো লেগে যায় প্রথম দেখাতেই। একপর্যায়ে সেও প্রস্তাব দেয়। তবে প্রস্তাবে নাকচ করা ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ আমি ইউরোপে কেবল পা রেখেছি এবং আমার জীবনে তখনো স্থিতিশীলতা ছিল না, এখনো নেই। এরপরেও দীর্ঘদিন তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। আমার মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গে তারটা হারিয়ে ফেলি, এরপর আর কখনো তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়ে উঠে নি। স্কোদারে আমার সঙ্গী ছিল এ আদেলিনা, বিদায়বেলা সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। সে এক অনাবিল প্রশান্তি, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি।

বেরাতের ক্যাসেলে নাদিয়া (ডানে), ও এলিফ (বায়ে) সঙ্গে লেখক
বেরাতের ক্যাসেলে নাদিয়া (ডানে), ও এলিফ (বায়ে) সঙ্গে লেখক

প্রায় ছয় সপ্তাহ পর আমি আবার আমার গন্তব্যে ফিরে আসি, ফেরার পথে এক ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম। উইজ এয়ারের ফ্লাইট বুকিং-এর ক্ষেত্রে একটি নিয়ম রয়েছে যেটি আমার জানা ছিল না। ফ্লাইটে ওঠার আগে অনলাইনে চেক ইন করতে হবে। ফ্লাইটের সময়ের পূর্বের ৪৮ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার পূর্বের দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সময়সীমা থাকে অনলাইনে এ চেক ইন করার জন্য। এ বিষয়টি আমার জানা ছিল না যেহেতু আলবেনিয়া ছিল ইউরোপে আসার পর আমার প্রথম কোনোও ভ্রমণ, তাই কাউন্টার থেকে আমাকে বলা হয় ৩৫ ইউরো দেওয়ার জন্য। কেউ যদি অনলাইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চেক ইন করতে না পারে তাহলে এয়ারলাইনসের কাউন্টারে তাকে চেক ইন করার জন্য ৩৫ ইউরো পরিশোধ করতে হয়। আমার মানিব্যাগে সে সময় ছিল মাত্র ২৫ ইউরো। এক ধরনের অস্বস্তিদায়ক অবস্থা বলতে গেলে এক কথায়! চারদিকে কেবল সরষে ফুল দেখছি।

দীর্ঘক্ষণ এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করার পর মাত্র ১০ ইউরোর জন্য নির্ধারিত গন্তব্যে যাত্রা আটকে যাবে? অঝোরে কেঁদে দিয়েছিলাম কোনো উপায় না দেখে। এ পর্যায়ে আমার পাশের থেকে এক ভদ্রমহিলা ও তার মেয়ে আমাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। আমার বিপদের কথা শুনে কোনোও ধরনের কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আমাকে ১০ ইউরো তারা দিয়ে দেন। সে যাত্রায় তাদের কারণে আমি বড় একটি বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাই। এখনো সে ভদ্রমহিলার মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, কয়েক দিন আগে সে নতুন সন্তানের মা হয়েছে। আমাকে সে নিজের ছোট ভাইয়ের চোখে দেখে।

সুখ-দুঃখসহ নানা অনুভূতি দিয়ে গড়া আমার এ আলবেনিয়ার ডায়েরি, ইউরোপে আসার পর প্রবাস জীবনের একটা সেরা সময় বলতে গেলে আলবেনিয়াতে ফেলে এসেছি। বিশেষত এখানকার স্থানীয় মানুষের থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি সেটি সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে আমার জীবনে অন্যতম সেরা পাওনা। ইউরোপে আমার দেখা সেরা দেশ হচ্ছে রোমানিয়া এবং এরপরই আলবেনিয়াকে রাখা যায়। এ দুই দেশের মানুষ সত্যি অনেক বেশি মাত্রায় আন্তরিক এবং আলবেনিয়ার মানুষের সব সময় একটা কথা বলে—

‘We love hospitality and it’s the most essential part of our nationality’. অর্থ হচ্ছে আমরা আতিথিয়েতাকে ভালোবাসি এবং এটি আমাদের জাতিসত্তার প্রধান অংশ।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া!