পুরো বাসা কোয়ারেন্টিন করেও স্বস্তি নেই

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন ১৪তম পর্ব।

মেয়েটা ভালো ফিল করছে না, মুখের রুচি নাই। এটা বেশ বড় সমস্যা। বলছে পেটে ব্যথা হচ্ছে, মনে হয় হাঙ্গার পেইন! মেয়ের বাবা মাস্ক পরে আছে, কমপ্লেন করছে না। আমি টায়ার্ডনেস আর একটু কনজেশন ছাড়া অনেক ভালো। সুপ বানাতে গিয়ে লাজানিয়া (মোটা নুডলস, চিকেন সস আর চিজ দিয়ে) বানিয়ে ফেললাম কিন্তু কারও খেতে ইচ্ছা নাই।

গতকাল মা ফোন দিয়েছে, বাসায় সেমায় নেই। কাল ঈদ, সেমাই যেন একটা পাঠাই। জামাইরে প্যাকেট দেখিয়ে দিলাম। দোকানে গিয়ে খুঁজে পায় না। ছবি পাঠাতে বলছে। পাবে না জানা কথা, গ্রোসারি দেশি স্টাইলে হলে আমাকেই করতে হয়। ছবি পাঠানোর পরও পায়নি। পাশেই নতুন একটা ইন্ডিয়ান গ্রেসারি, শেষে সেখানে গিয়ে পেল!

মেয়েকে গোসল করে ফ্রেশ হতে বললাম। কনজেশন কমবে, ভালো ফিল করবে। একবার মনে হচ্ছে এটা করি, আরেকবার ওটা, শেষে কোনটাই না করে, রেস্ট নিতে গেলাম। ফুচকা আনতে বলেছিলাম গত দিন অনেক ঝাল দিয়ে, রুচিহীন মুখে আরও ঝাল দিয়ে খেতে গিয়ে বুঝলাম মুখ পুড়িয়ে ফেলেছি! সবকিছুতে এক্সট্রা পেপার, মরিচ দিয়ে বসে আছি, তারপরও খেতে ভালো লাগে না।

গতকাল হজ শুরু হয়েছে, মাত্র এক হাজার সৌদি নিবাসী এবার হজ করতে পারছেন (২০২০), ইতিহাসে হাজার বছরে এটাই প্রথম! তারপরও দেখি ফেবু গরু–খাসির ছবিতে পূর্ণ! যাক যার যাতে সুখ। বান্ধবী ফোন দিয়েছে, তার বাসায় রান্না শুরু করেছে! ওর বরাবর অনেক শখ। কোরবানি দিচ্ছে। আমার বাবা তার ভাইয়ের কাছে কোরবানির টাকা পৌঁছে দিয়েছে। আমরা এবার টাকাটা চ্যারিটিতে ডোনেট করব। পৃথিবীর আরও করুণ সময় আসছে। সবখানে খাবারের হাহাকার শুরু হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে যাদের কাজ নেই, তাদের কেনার ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে! আমরা কি এক ইতিহাসের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি, এখনো হয়তো বুঝতে পারছি না!

চীন এই তিন মাসে সারা পৃথিবীর হাতে ভিক্ষার থালা আর মৃত মানুষের স্তূপ উপহার দিয়ে দিল, সবাই নিরুপায় হয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারল না। করার নেই ও!

মেয়ে দেখি কতক্ষণ পর এসে বলছে আবার ব্যথার কথা। এবার একটু নড়েচড়ে বসে চেক করে দিলাম। নরমালি ও কিছু নিয়ে কমপ্লেন করে না। দেখি রিবসের/বোনের পেইন; খুব জ্বালিয়েছে আমাকেও। ওষুধ খেতে বললাম।

মায়ের বাসার খাবার আনতে গিয়ে, আমার বর তার আরও কাজ শেষ করে আসতে আসতে দেরি করেছে অনেক। আনতেই সবাইকে খেতে দিলাম। পেট ঠান্ডা করে সবাই রেস্ট নিক। মেয়েকে কতক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করলাম, ব্যথা কমেছে কি না? বলে কমেছে। আজ আরলিই ঘুমাতে গেল। সারা বাসা কোয়ারেন্টিন করেও আমাদের স্বস্তি নেই।

বাবা জানাচ্ছে ছোট ভাই হসপিটালে গেছে, ওর বউ প্র্যাগনেন্সি কমপ্লিকেশনে হয়ে হসপিটালে ভর্তি মাসখানেকের মতো! ও সাপোর্ট দিতে থাকে সেখানে, স্ট্রেস সবার এত বেশি এখন! দেখি খোঁজ নিই ওর আবার কী হলো। আমরা সবাই পৃথিবীর সব প্রান্তে এমনভাবে ছড়িয়ে আছি, কোভিড না গেলে কেউ কাউকে ফিজিক্যালি দেখতেও পারব না! মানসিক সাপোর্ট ছাড়া দেওয়ার কিছু নেই। আর এই মহামারির পর কে কী অবস্থায় থাকব, শুধু ওপরওয়ালা জানেন।

কাল আবার ঈদ এখানে, মা জানতে চাচ্ছে কী রান্না করে দেবে, আসলে তাঁর ওপর অত্যাচার হয়ে যায়। মিনিমাম যা করতে পারে, সেটাই করতে বললাম। না করলেও সমস্যা নেই। খাবারে ফ্রিজ এমনিতেই ভরা। এদিকে আবার কর্তা খোঁজ নিচ্ছে, কোথায় ঈদ জামাত হবে! মনে করিয়ে দিলাম, খোঁজ না করতে, কারণ তার কোনো গ্যাদারিংয়ে যাওয়া চলবে না। অনলি অ্যাসেনশিয়াল কাজে বাইরে যেতে পারবে। ছেলের সঙ্গে ঘরে জামাত করে নামাজ পড়ে। আমি ছেলে নিয়ে চিন্তায় থাকি! এখনো টেস্টের রেজাল্ট পাইনি। তবে আমি শিওর, পতিদেবতা পজিটিভ।

এদিকে ঘুমভাব ছুটে গেল...মনে হচ্ছে—গাড়ির হর্ন শুনতে পাচ্ছি! ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার? মনে হচ্ছে মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ড বা চড়পাড়া মোড়! ভীষণ অস্বস্তিকর বিষয়। এমন বিদঘুটে শব্দ এই সুনসান মৃত্যুপুরীতে?

ছেলে গেম খেলার সময় অনেক সময় আবহসংগীতের মতো বাদ্যযন্ত্র বাজায়। ভাবছি ও–ই হয়তো; বকতে গিয়ে মনে হলো, ও খেলছে না এখন। ডিনার করে কয়েক মিনিট বেড়ালের সঙ্গে খেলে। এবার এই গাড়ির শব্দের উৎস জানতে হবে, সামনের দরজায় গেলাম। দরজা খুলতেই দেখি, এক দঙ্গল গাড়ি বাসার সামনে কারও জন্মদিন, ড্রাইভথ্রু সেলিব্রেট করছে! করোনায় এটি নতুন সংযোজন, যেহেতু কাছে বসে সেলিব্রেট করা যাবে না, সামনের বাসার পিচ্চির বছরপূর্তি বাবা–মা বন্ধুদের সঙ্গে এভাবে কয়েক মিনিটে সেলিব্রেশন করছে! আমিও শব্দের উৎস জেনে স্বস্তি পাচ্ছি, হ্যালুসিনেট করছি না জেনেই স্বস্তি! চলবে...