আমেরিকার অদ্ভুত কিছু ব্যাপারস্যাপার-২

ড্রাইভ থ্রু ফাস্ট ফুড সার্ভিস। ছবি: লেখক
ড্রাইভ থ্রু ফাস্ট ফুড সার্ভিস। ছবি: লেখক

দেশের বাইরে গেলে সবাই কমবেশি কালচারাল শখের মুখোমুখি হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার ব্যতিক্রম সব রীতি বা প্রথা গা সয়ে গেলেও স্মৃতিচারণা করে লিখে ফেললাম কিছু কিছু। আজকের লেখাটি এই বিষয়ের দ্বিতীয় পর্ব।

১.
আমেরিকায় কাগুজে নোটের ব্যবহার খুবই কম। প্রায় সব কেনাকাটা ও লেনদেন ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে করা যায়। ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি কিছু সংখ্যামাত্র। মাস শেষে ব্যাংকে বেতন আসে সংখ্যা হিসেবে, সেই সংখ্যাগুলো ঘুরপাক খায় ক্রেডিট কার্ডের পাওনা পরিশোধে কিংবা অন্যান্য লেনদেনে।

২.
খাদ্যদ্রব্যসহ বেশির ভাগ পণ্যের দাম একেক স্টোরে একেক রকম। আমাদের দেশের মতো এখানে কোনো পণ্যের গায়ে দাম ও ট্যাক্স লেখা থাকে না। স্টোরের অবস্থান অনুযায়ী দামের ভিন্নতা দেখা যায়। এর কারণ একেক স্টেটে ট্যাক্সের রেট একেক রকম। আবার আমাদের ওরেগন স্টেটে কেনাকাটার ক্ষেত্রে কোনো ট্যাক্স নেই।

বিলবোর্ডে আইনজীবীর বিজ্ঞাপন। ছবি: লেখক
বিলবোর্ডে আইনজীবীর বিজ্ঞাপন। ছবি: লেখক

৩.
এখানে বেশির ভাগ স্টোর, সেলুন, জিম, কফিশপ ও রেস্তোরাঁর রয়েছে চেইন ব্যবসা। ভিন্ন স্টেটে গেলেও একই নামের শপ থেকে মোটামুটি একই রকম সেবা পাবেন। ছোট ছোট দোকানের চেয়ে সুপারশপ বেশি। কিছু কিছু সুপারশপে ঢুকলে খাদ্যদ্রব্য, কাপড়চোপড়, আসবাব সবই পাবেন একসঙ্গে।

৪.
কিছু কিছু ফাস্ট ফুড ও কফিশপ ড্রাইভ থ্রু সেবা দিয়ে থাকে। গাড়ি শপের জানালার পাশে নিয়ে অর্ডার দেবেন, এক–দুই মিনিটের মধ্যে গাড়িতে বসেই আপনার খাবার ডেলিভারি পেয়ে যাবেন। কিছু কিছু ব্যাংকও ড্রাইভ থ্রো সার্ভিস দেওয়া শুরু করেছে ইদানীং। করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা বা লেনদেনের ক্ষেত্রে এই অপশনটা বেশ কাজে দিচ্ছে।

৫.
বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ একটা মেনুতে অনেক পরিমাণে খাবার দেয়। আমাদের বাসার কাছের ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁর বিরিয়ানি দুই–তিন বেলা অনায়াসে খাওয়া যায়। অতিরিক্ত খাবার প্যাকেটে করে বাসায় নিয়ে আসা এখানকার অনাপত্তিকর প্রথা। শুনেছি প্রথম প্রথম ফাস্ট ফুডের জনপ্রিয়তা বাড়ার সময়ে সাধারণ রেস্তোরাঁগুলো ব্যবসা ধরে রাখতে খাবারের পরিমাণ বাড়ানোর এই সংস্কৃতি চালু করে। তবে কৃপণীয় পরিমাণের খাবার দেয় এ রকম কয়েকটা রেস্তোরাঁও দেখেছি।

৬.
বইয়ের দাম এখানে অপ্রত্যাশিত পরিমাণে বেশি। আমাদের গ্র্যাজুয়েট লেভেলের একেকটা বইয়ের দাম ছিল ১৫০-৩৫০ ডলার, যা বাংলাদেশে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো। তবে আশার কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বেশির ভাগ বই পাওয়া যেত, ধার নিয়ে গ্র্যাজুয়েট লেভেল পার করে দিতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। এখানকার বেশির ভাগ স্থানীয় ছাত্ররা অবশ্য এত দাম দিয়ে হলেও বই কিনে ফেলত। বইয়ের এমন আকাশচুম্বী দাম দেখে আমার নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোর কথা মনে পড়ত। কত কম খরচে আমরা দেশে পড়াশোনা করে আসতে পেরেছি।

পাবলিক টয়লেটের দরজার বিশাল ফাঁকা জায়গা আপনাকে ফেলে দিতে পারে অস্বস্তিকর অবস্থায়। ছবি: লেখক
পাবলিক টয়লেটের দরজার বিশাল ফাঁকা জায়গা আপনাকে ফেলে দিতে পারে অস্বস্তিকর অবস্থায়। ছবি: লেখক

৭.
বইয়ের দামের মতো শিক্ষাব্যবস্থায় খুবই খরচ এখানে। হোক সেটা বেসরকারি কিংবা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বেশির ভাগ ছাত্রই ব্যাংকঋণের বিশাল বোঝা মাথায় নিয়ে পড়াশোনা করে। পাস করে চাকরি পাওয়ার পর প্রথম পাঁচ বছরে এই ঋণ শোধ করা লাগে। তবে সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করতে তুলনামূলক কম খরচের কমিউনিটি কলেজ এবং বিভিন্ন বৃত্তির ব্যবস্থা আছে।

৮.
বাংলাদেশের মতো আমেরিকায় কোনো প্রধান খাদ্য নেই। আমরা যেমন ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবাই দুই–তিন বেলা ভাত খাই, এখানে মোটেই এমন না। খাদ্যাভ্যাস একেক পরিবারে একেক রকম। প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকাও আমাদের মতো নির্দিষ্ট না। এর কারণ আমেরিকার বর্তমান নাগরিকরদের পূর্বপুরুষেরা এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তাদের দেশের খাদ্যাভ্যাস। এর ফলে সাধারণ কোনো প্রধান খাবারের ব্যাপার আসেনি। তবে আমার মতে, এদের প্রধান খাবার চিজ বা পনির। বেশির ভাগ ফাস্ট ফুডের মধ্যেই চিজের আধিক্য থাকে। অনেকে আবার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য সালাদ খায়। আমাদের দেশে ভেজেটেরিয়ান এবং ভেগান মানুষ খুব কম দেখা গেলেও এখানে অহরহ দেখা যায়। যেকোনো ইভেন্টে তাদের জন্য আলাদা খাবার রাখার চেষ্টা করা হয়।

৯.
বেশির ভাগ খাবারে অতিরিক্ত চিজ অথবা চিনি থাকে বলেই কি না এ দেশে স্থূলতার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। স্থূল মানুষের ওজনও অনেক বেশি, আমাদের দেশের স্থূল মানুষ বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

১০.
বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথির সংখ্যা থাকে একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন। ৫০-১০০ জনের মতো থাকে সাধারণত। খুব কাছের আপনজনেরাই আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। আমাদের দেশে প্রতি অনুষ্ঠানে ৫০০-১০০০ মানুষ দাওয়াত পায় শুনে ওরা বেশ অবাক হয়। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনের সম্পত্তি হয়ে যায় কমন বৈবাহিক সম্পত্তি। বিবাহবিচ্ছেদের পর বৈবাহিক সম্পত্তি ৫০-৫০ রুল অনুযায়ী সমান দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ জন্য আগে থেকেই দুজন একসঙ্গে অনেক দিন একই ছাদের নিচে থেকে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ঠিক করে নেয়। ক্ষেত্রবিশেষে প্রথম বা দ্বিতীয় বাচ্চা নেওয়ার পর আনুষ্ঠানিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

১১.
আমেরিকার বাইরে থেকে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমেরিকা সম্পর্কে জানি হলিউডের মুভি-সিরিজ দেখে কিংবা মিডিয়ার মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে হলিউড আমেরিকার ৩ শতাংশও প্রতিনিধিত্ব করে না। বাইরে থেকে আমেরিকায় পারিবারিক বন্ধন দুর্বল মনে হলেও সত্যিকার অর্থে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখানে পারিবারিক বন্ধন বেশ দৃঢ়। প্রায় সব পরিবারে ৪-৫টা করে শিশুসন্তান আছে। আমাদের দেশের মতো জনসংখ্যা এখানে বড় কোনো সমস্যা না, ২ সন্তান বা ১ সন্তানের রীতি উৎসাহিত করারও ব্যাপার নেই।

আমেরিকান ফুটবল খেলা হয় হাত দিয়ে। ছবি ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় বনাম ওরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাচ। ছবি: লেখক
আমেরিকান ফুটবল খেলা হয় হাত দিয়ে। ছবি ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় বনাম ওরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাচ। ছবি: লেখক

১২.
কোনো ভবনে প্রবেশের সময় পেছনের ব্যক্তির জন্য দরজা খুলে ধরে রাখা সাধারণ ভদ্রতা। কম ব্যস্ত ফুটপাতে হাঁটার সময় অপরিচিত মানুষকে দেখে হাসি দেওয়া এবং হাই-হ্যালো বলাও ভদ্রতা।

১৩.
এখানকার কাস্টমার সার্ভিস সাধারণত খুবই ভালো। তবে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার সার্ভিসে কল দিলে অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করা লাগে। সেটা ১০ মিনিট থেকে ৪০ মিনিটও হতে পারে। কিছু কিছু কাস্টমার কেয়ারে কল দিলে ১ প্রেস করো, ৩ প্রেস করো এসব শুনে শুনে দেখবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত সার্ভিসের অপশনই খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার পেলেও ১০ মিনিট পর শুনবেন এই মুহূর্তে কোনো এজেন্ট খালি নেই, আপনার অপেক্ষার সময় ৩৭ মিনিট। তা–ও ভালো। সম্প্রতি করোনার মৌসুমে আমার ক্ষেত্রে এ রকমও কয়েকবার হয়েছে ১০ মিনিট পর শুনি কেউ খালি নেই, পরদিন কল করো। পরদিনও একই কথা।

১৪.
বেশির ভাগ স্টেটে রোদের প্রখরতা দেশের তুলনায় বেশি। সামারে গাড়ি চালাতে গেলে বেশির ভাগ সময় সানগ্লাস পরে চালাতে হয়। সানগ্লাসের এমন বহুল ব্যবহার দেশে চোখে পড়েনি কখনো।

১৫.
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যতীত লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অস্তিত্ব নেই আমেরিকায়। একইভাবে মশাও চোখে পড়েনি আমার। তবে কোথাও কোথাও হালকা মশা দেখা যায় বলে শুনেছি। মশার উৎপাত কিংবা মশাবাহিত রোগ নিয়ে হইচই শুনিনি কখনো। আমার ধারণা, বেশির ভাগ আমেরিকান ডেঙ্গুর নামই শোনেনি। তবে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের হাতে গোনা কয়েকটা কেস কয়েক বছর আগে রিপোর্ট হয়েছে।

১৬.
বিলবোর্ড কিংবা টিভিতে ডাক্তার এবং আইনজীবীর বিজ্ঞাপন না হয় মানা যায় কিন্তু অনেক সময় প্রেসক্রাইভড ওষুধেরও বিজ্ঞাপন দেখা যায়। বিজ্ঞাপনে বলে দেয় তোমার ডাক্তারকে এই ওষুধটি লিখতে বলবে। তবে বিজ্ঞাপন থেকে আপনি ওষুধ সম্পর্কে জানলেও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওই সব ওষুধ কিনতে পারবেন না। তবে বিলবোর্ডে আইনজীবীর বিজ্ঞাপনও এখানে দেখা যায়।

লেখক
লেখক

১৭.
আমেরিকায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুবই জটিল এবং ব্যয়বহুল। ইনস্যুরেন্স ছাড়া চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিশাল খরচের ব্যাপার। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সিরিয়াল পেতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়। চিকিৎসা নেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে বিল আসবে না। ইনস্যুরেন্স ঘুরে বিল আসতে এক–দুই মাস লেগে যায়। বিল পাওয়ার আগে সহজে বোঝার উপায় নেই কত আসবে এবং ইনস্যুরেন্স কতটুকু কাভার করবে।

১৮.
অন্য দেশ থেকে এসে পাবলিক টয়লেট বা রেস্টরুম ব্যবহার করতে গেলে প্রথম দিকে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়। টয়লেটের দরজার সাইডে এবং নিচে বেশ খালি থাকে, আপনি শুরুতে বেশ অস্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব মানিয়ে যায়। পাবলিক টয়লেটের দরজার বিশাল ফাঁকা জায়গা আপনাকে ফেলে দিতে পারে অস্বস্তিকর অবস্থায়।

১৯.
আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। নামে ফুটবল হলেও এই ফুটবল আমাদের পরিচিত ফুটবল না, এটি খেলতে হয় হাত দিয়ে। অদ্ভুত নামকরণ! পায়ে খেলা চিরাচরিত ফুটবলকে এখানে বলে সকার। কলেজ ফুটবল নিয়ে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বর্তমান ও পুরোনো ছাত্ররা দল বেঁধে আসে খেলা দেখতে। গাড়িতে করে বারবিকিউ-এর সরঞ্জাম আর ড্রিংকস আনে সঙ্গে করে, পার্টি করে খেলার আগের কিংবা বিরতির সময়টা উপভোগ করে। খেলার মাঠে চিয়ার লিডাররা থাকে ছোট ছোট বিরতির সময়গুলোয় বিনোদন দিতে। মাঝের বড় বিরতিতে প্রায় সব সময়ই থাকে চিয়ার লিডারদের বিশেষ পরিবেশনা।

২০.
সরকারি যেকোনো কর্মীর কাছে সেবা নিতে গেলে কিংবা পুলিশের মুখোমুখি হলে আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করবে। আমাদের দেশেও অফিশিয়ালি এটিই নিয়ম, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের উল্টোটা করার রেওয়াজ হয়ে গেছে।

২১.
এ দেশের বড় শহরগুলোয় গেলে একদিকে যেমন চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তেমনি অনেক বেশি হোমলেস বা উদ্বাস্তু দেখলে মন কিছুটা খারাপও হয়। আমাদের দেশে অনেক গরিব মানুষ থাকলেও এখানকার মতো এত বেশি উদ্বাস্তু ঢাকা শহরে দেখিনি। ভিন দেশের ভিন্ন রীতি একটা সময় পর্যন্ত নজরে পড়লেও এখন আর ভিন্ন কিছু মনে হয় না। জীবন যেখানে যেমন।

*লেখক: প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার, ইনটেল করপোরেশন, পোর্টল্যান্ড, ওরেগন, যুক্তরাষ্ট্র