Thank you for trying Sticky AMP!!

অতৃপ্তি-হতাশায় শেষ ইলিশের মৌসুম

ইলিশ মাছ

ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের অতৃপ্তি আর জেলেদের হতাশার মধ্যেই শেষ হলো এবারের ইলিশের মৌসুম। আহরণে ধস নামায় চড়া দামের কারণে এবার বেশির ভাগ মানুষের পাতেই ওঠেনি ইলিশ। ফলে ক্রেতারা যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনি কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে হতাশ জেলে ও ব্যবসায়ীরা।

এরই মধ্যে গতকাল বুধবার মধ্যরাত থেকে সাগর-নদীতে প্রজনন মৌসুমের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পার হলেই শেষ হবে ইলিশের মৌসুম। এরপর নভেম্বর থেকে আট মাসের জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে।

Also Read: ইলিশ মৌসুমের শেষের দিকের বিকিকিনি

বুধবার মধ্যরাত থেকে সাগর-নদীতে প্রজনন মৌসুমের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পার হলেই শেষ হবে ইলিশের মৌসুম। এরপর নভেম্বর থেকে আট মাসের জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে।

দেশের অন্যতম বৃহত্তম মৎস্য অবতরণকেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের হিসাবেও এবার ইলিশ আহরণে ধস নামার চিত্র পাওয়া যায়। কেন্দ্রের বিপণন কর্মকর্তা রিপন হোসেন হিসাব দিয়ে জানান, বন্দরে জুলাই মাসে ১৫৫ টন ইলিশ এসেছে। এ ছাড়া আগস্টে ২৭৯, সেপ্টেম্বরে ৪৬৭ ও ১০ অক্টোবর পর্যন্ত বন্দরে ৫ টন ইলিশ আসে।

তবে বন্দরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরও প্রতিদিনই ২২ থেকে ২৫ টন ইলিশ আসত। এবার মাছ কম আসায় দামও চড়া। এ জন্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে ইলিশ। পাথরঘাটা অবতরণকেন্দ্রে রপ্তানিযোগ্য আকারের মাছ (৭৫০ থেকে ৯০০ গ্রাম) পাইকারি প্রতি মণ ৪৮ থেকে ৬৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া এক কেজি বা তাঁর চেয়ে বড় ইলিশের মণ ৫৮ থেকে ৮০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর জাটকা বিক্রি হয়েছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা মণ দরে। গত বছর ওজনভেদে প্রতি মণ ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা কমে বিক্রি হয়েছিল।

নদনদীর গভীরতা হ্রাস, দূষণসহ নানা কারণে ইলিশের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। সংবেদনশীল হওয়ায় ইলিশ ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তন করে। কলাপাড়ার রাবনাবাদ নদী ও বরগুনার পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর মোহনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াও ইলিশের বিচরণস্থল ঘিরে শিল্পায়নের ফলে নদীদূষণ ইলিশের উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে।
মীর মোহাম্মদ আলী, বিভাগীয় প্রধান, অ্যাকুয়াকালচার বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের আরেক বড় ইলিশের মোকাম চাঁদপুরে গত শনিবার প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ ইলিশ আসে। দাম পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিংবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, এবার বলতে গেলে তাঁরা ইলিশবিহীন একটি মৌসুম পার করলেন। মৌসুমের শেষে ঝড়বৃষ্টি হলেও নদীমুখী হয়নি ইলিশ। ইলিশের উৎপাদন কমার কারণ চিহ্নিত করে সমস্যার সমাধান না করলে ভবিষ্যতে ইলিশসম্পদ হুমকির মুখে পড়তে পারে।

মৎস্য–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় এক দশক ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছিল। বিশ্বে মোট ইলিশের ৮০ শতাংশ বাংলাদেশে আহরিত হয়। কিন্তু এবার সাগর ও নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইলিশের মূল মজুতেই কোনো সমস্যা হয়েছে। এ জন্য নিবিড় গবেষণা দরকার।

Also Read: যে কারণে এবার ভরা মৌসুমেও ইলিশ কম

যে কারণে এবার ইলিশ কম

ইলিশ আহরণ ও প্রজনন বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, নদীর স্রোত, গভীরতা, জলস্ফীতি, খাদ্য ও পানির গুণগতমানের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রাকৃতিকভাবেই দক্ষিণাঞ্চলের নদ–নদীগুলোয় ডুবোচর ও পলি জমে গভীরতা হ্রাস পেয়েছে। এ অঞ্চলের নদ–নদীগুলোর তীরে বড় বড় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় নদী দূষিত হচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে। এ ছাড়া এবার বর্ষায় স্বাভাবিক এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়নি।

বরিশাল আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জুনে বরিশাল অঞ্চলে ৪০৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। হয়েছে মাত্র ২২৩ মিলিমিটার। জুলাইয়ে ৪০৭ দশমিক ৩ মিলিমিটারের স্থলে বৃষ্টি হয়েছে অর্ধেকেরও কম ১৮৬ মিলিমিটার। তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগস্টে ৩৭১ দশমিক ৩ মিলিমিটারের স্থলে হয়েছে ৬০২ মিলিমিটার। আর সেপ্টেম্বরে ২৫৯ মিলিমিটারের স্থলে ৩৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অক্টোবরে বৃষ্টি হওয়ার কথা ১৫৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার। মাসের প্রথম ১০ দিনেই ২৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

Also Read: কক্সবাজার উপকূলে ইলিশ উধাও, প্রায় খালি হাতে ফিরছেন জেলেরা

এবারের ইলিশ মৌসুম শেষ। গতকাল মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা সাগর থেকে ফিরে আসছে ট্রলার।বুধবার দুপুরে পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে

বরিশাল আবহাওয়া বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, বৃষ্টিপাতের তথ্য-উপাত্ত দেখলে বোঝা যায়, বৃষ্টির মৌসুম সরে গেছে, তা হেমন্তের শুরু পর্যন্ত অব্যাহত থাকছে। বৃষ্টিপাতের এ পরিবর্তন প্রকৃতির অনেক অনুষঙ্গকেই পরিবর্তিত করছে।

বর্ষাকাল সরে গেলেও বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত তেমন ইঙ্গিত দেয় না। এমতাবস্থায় ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, নদনদীর গভীরতা হ্রাস, দূষণসহ নানা কারণে ইলিশের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। ইলিশ সংবেদনশীল মাছ। বাসস্থান পরিবর্তন হলে ঘন ঘন গতিপথও পরিবর্তন করে। কলাপাড়ার রাবনাবাদ নদী ও বরগুনার পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর মোহনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াও ইলিশের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রগুলো ঘিরে শিল্পায়নের ফলে নদীদূষণ ইলিশকে পথ পরিবর্তনে বাধ্য করছে। এতে দেশের ইলিশ উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে।

Also Read: ১২ অক্টোবর থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ

প্রাকৃতিক কারণে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের নদীগুলোর অবস্থা ভালো নয়, স্রোত কমে গেছে। দূষণের কারণে খাবারের সংকট হচ্ছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ জাল দিয়ে লাখ লাখ টন ইলিশসহ অন্যান্য মাছের পোনা নিধনের কারণেও ইলিশ আহরণ কম হতে পারে।
আশরাফুল আলম, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, জাটকা সুরক্ষার ব্যাপারেও কয়েক বছর ধরে ব্যাপক উদাসীনতা ছিল। পাশাপাশি সাগর মোহনায় ছোট ফাঁসজালের অবাধ ব্যবহার ইলিশের মজুতকে হুমকিতে ফেলেছে। ইলিশ রক্ষায় ব্যবস্থাপনা কাঠামোকে ঢেলে সাজানো ও নিবিড় গবেষণা দরকার।

তবে চাঁদপুরের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলমের ভাষ্য, এবার নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়লেও সাগরে ভালো ইলিশ ধরা পড়েছে। এখন সারা বছরই নদী-সাগরে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, ইলিশ সারা বছরই ডিম পাড়ে। তবে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ডিম ছাড়ে অক্টোবরের এই পূর্ণিমাকে ঘিরে। যখন ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকে।

আশরাফুল আলম আরও বলেন, ‘গত বছর আমরা নদীতে যে পরিমাণ জাটকা দেখেছি, এবার সেই পরিমাণ ইলিশ কেন মিলছে না—এটা বড় একটি প্রশ্ন। এর পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে। প্রাকৃতিক কারণে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের নদীগুলোর অবস্থা ভালো নয়, স্রোত কমে গেছে। দূষণের কারণে খাবারের সংকট হচ্ছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ জাল দিয়ে লাখ লাখ টন ইলিশসহ অন্যান্য মাছের পোনা নিধনের কারণেও ইলিশ আহরণ কম হতে পারে।’

Also Read: চট্টগ্রামে ধরা পড়ছে না পর্যাপ্ত ইলিশ, বৃষ্টির আশায় জেলেরা

সহায়তা পাবেন ৩ লাখ ৭ হাজার জেলে

কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই জেলেপাড়াগুলোতে হতাশা-দুর্দশা চলছে। এর মধ্যে বুধবার থেকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। এতে কপালে ভাঁজ পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত পাঁচ লাখ জেলের।

বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগে জেলে আছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে ৩ লাখ ৭ হাজার ৪১ জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল–সহায়তা দেওয়া হবে।

Also Read: ইলিশ এখন কূটনীতির বিষয়ে পরিণত হয়েছে: প্রাণিসম্পদমন্ত্রী

এবার ইলিশ কম ধরা পড়ায় দামও চড়া। এ জন্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে ইলিশ

জেলে দুলাল মিয়া বলেন, এবারের মৌসুমে সাগরে চারটি ট্রিপ দিয়েছেন। তিনটিতেই দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লোকসান গুনেছেন। একটি ট্রিপে সমান সমান ছিল। দাদন নিয়ে সাগরে গিয়েছিলেন। মাছ না পাওয়ায় দেনায় পড়ে গেছেন। ২২ দিনের অবরোধে আরেক দফা ঋণ বাড়বে। সরকারের ২৫ কেজি চালে তো মাস চলে না। বাজার-সওদা করা লাগে। আবার যত জেলে তত সহায়তাও আসে না। যা আসে, তা-ও প্রকৃত অনেক জেলে পান না।

বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে জেলেদের সহায়তার চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তালিকা করে তা বিতরণ করবেন। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

Also Read: অধিকাংশ ট্রলারের জেলেরা ইলিশ না পেয়ে ফিরে আসছেন