Thank you for trying Sticky AMP!!

এক ইউনিয়নে শতাধিক বাল্যবিবাহ

ভেদুরিয়া ইউনিয়নের তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসার এসব ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে বলে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা জানিয়েছেন।

বাল্যবিয়ে

ভোলা সদর উপজেলার এক ইউনিয়নেই গত এক বছরে শতাধিক বাল্যবিবাহ হয়েছে। শুধু একটি বিদ্যালয়ের ৫৯ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

ভেদুরিয়া ইউনিয়নের মো. ছানা উল্লাহ নামের এক কাজি ও তাঁর নিয়োগ করা ৯ জন সহকাজি বাল্যবিবাহ পড়িয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছানা উল্লাহ ভেদুরিয়া ইউনিয়ন কৃষক লীগের যুগ্ম সম্পাদক। সম্প্রতি স্থানীয় এক ব্যক্তি ছানা উল্লাহের বিরুদ্ধে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়ে তাঁর সনদ বাতিল ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা, শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে চলতি নভেম্বর পর্যন্ত ভেদুরিয়া ইউনিয়নের তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসার শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকেরহাট সমবায় বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ৮ জন, সপ্তম শ্রেণির ১০, অষ্টম শ্রেণির ১২, নবম শ্রেণির ১৪ ও দশম শ্রেণির ১৫ জনসহ মোট ৫৯ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। উত্তর চর ভেদুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া ব্যাংকেরহাট ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা ও ব্যাংকেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আরও প্রায় ২৫ ছাত্রীর বাল্যবিবাহের খবর পাওয়া গেছে।

ব্যাংকেরহাট সমবায় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হাদিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা অভিভাবকেরা তাঁদের মেয়েদের একটু ভালো ছেলে পেলেই বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু বিষয়টি আমরা জানতে পারি না। তাঁরা আইনকানুনের তোয়াক্কাও করেন না। শিক্ষার্থীরাও আমাদের জানায় না।’

বিয়ে না দিয়ে উপায় কী? তিন মেয়েকে একসঙ্গে পড়াতে মাসে কমপক্ষে তিন-চার হাজার টাকা দরকার। এত টাকা কোথায় পাব?
আলিমুদ্দীনের স্ত্রী

বিপদে পড়ে বিয়ে

গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভেদুরিয়া ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ হওয়া ১০ ছাত্রীর অভিভাবক ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, মা–বাবার অসুস্থতা, বখাটের দ্বারা উত্ত্যক্তের শিকার হওয়া ও প্রেম করে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন অভিভাবকেরা।

উত্তর ভেদুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা আলিমুদ্দীন (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ‘যোগ্য পাত্র’ পেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আলিমুদ্দীনের স্ত্রী বলেন, ‘বিয়ে না দিয়ে উপায় কী? তিন মেয়েকে একসঙ্গে পড়াতে মাসে কমপক্ষে তিন-চার হাজার টাকা দরকার। এত টাকা কোথায় পাব? এখন দুই হাজার টাকার জন্য মেজ মেয়ের পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করাতে পারছি না।’

দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা অভিভাবকেরা তাঁদের মেয়েদের একটু ভালো ছেলে পেলেই বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু বিষয়টি আমরা জানতে পারি না। তাঁরা আইনকানুনের তোয়াক্কাও করেন না। শিক্ষার্থীরাও আমাদের জানায় না।
মো. হাদিসুর রহমান, প্রধান শিক্ষক, ব্যাংকেরহাট সমবায় বালিকা বিদ্যালয়

চর রমেশ গ্রামের বাসিন্দা আলেপ মিয়া (ছদ্মনাম) জাহাজে চাকরি করেন। তিন মেয়ের মধ্যে মেঝ মেয়েকে সম্প্রতি বাল্যবিবাহ দিয়েছেন তিনি। মেয়েটি বলল, ‘বাবা অসুস্থ। সবাই বলছে বাবা বাঁচবে না। তাই বিয়েতে মত দিয়েছি। বিয়ে হলেও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে আমার।’

Also Read: সাড়ে ৭ হাজার বাল্যবিবাহ

বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের ভাষ্য, তাঁরা যখন বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বিয়ের লিখিত বা মৌখিক অনুমতি দেন না, তখন অভিভাবকেরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদের কাছে গিয়ে বয়স বাড়িয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ নেন।

এত মেয়ের বাল্যবিবাহের খবর শুনে নিজেই অবাক হয়েছেন ভেদুরিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল। তাঁর দাবি, ‘আমার ইউনিয়নে কারও বিয়ে পড়াতে গেলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ হালনাগাদ করতে হয়। তারপরও কীভাবে স্কুল-মাদ্রাসার এত শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’

বাল্যবিবাহের বিষয়ে ভেদুরিয়া ইউনিয়নের কাজি মো. ছানা উল্লাহর বক্তব্য জানতে একাধিকবার তাঁর কার্যালয়ে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে কথা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাঁর আত্মীয়স্বজন স্থানীয় কিছু লোকজনের সঙ্গে মিশে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন। বাকি সব মিথ্যা।

কীভাবে স্কুল-মাদ্রাসার এত শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে
ভেদুরিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল

কৃষক লীগ নেতা কাজি

মো. ছানা উল্লাহ ভেদুরিয়া ইউনিয়ন কৃষক লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে আছেন। নিজের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে তিনি এলাকায় বাল্যবিবাহ পড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ৯টি ওয়ার্ডে ৯ জন নিজস্ব লোক নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন তিনি। তাঁরা মূলত বিয়ে পড়াতে সহায়তা করেন। তবে বাল্যবিবাহের জন্য সরাসরি কাজি ছানা উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাঁর নিজের বাড়ি সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়নের হাজিরহাট গ্রামে হলেও তিনি ভেদুরিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হিসেবে নিজের সব কটি সনদ নিয়েছেন।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ২০১২ সালে তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বাল্যবিবাহ পড়ানোর অভিযোগে কাজি ছানা উল্লাহর বালাম খাতা আটকে রাখেন। তখন তিনি এই কাজির বালাম খাতায় ব্যাপক হারে ঘষামাজা দেখতে পান। তখনই কৃষক লীগে পদ নেন ছানা উল্লাহ।

Also Read: পারভীন অথবা গাব্রিয়েলা, গল্পটি একই

ভেদুরিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাজি ছানা উল্লাহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ও ইউনিয়ন কৃষক লীগের যুগ্ম সম্পাদক। চেয়ারম্যান থাকাকালে ছানা উল্লাহর বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ এসেছিল। বর্তমানে ব্যাংকেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির পদে আছেন তাজুল ইসলাম। ওই বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বাল্যবিবাহের খবর তিনিও পেয়েছেন। এসব বিষয় শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

ভেদুরিয়া তাই অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন সেই ভূখণ্ডে কয়েক মাসের ব্যবধানে হয়ে গেল এক শর বেশি বাল্যবিবাহ।

কাজি ছানা উল্লাহর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগের উল্লেখ করে মো. খায়রুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা ও স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম চলতি বছরের এপ্রিলে আইন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ও ১০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব (জননিরাপত্তা বিভাগ) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে ভোলা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অভিযোগপত্রটি তাঁর কাছে এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু এটি এখনো তাঁর কাছে আসেনি।

ভেদুরিয়া ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডে ৫০ হাজার মানুষের বাস। বেশির ভাগের পেশা কৃষি ও মাছ ধরা। ভোলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত ইউনিয়নটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে তেতুলিয়া নদী। ভেদুরিয়া তাই অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন সেই ভূখণ্ডে কয়েক মাসের ব্যবধানে হয়ে গেল এক শর বেশি বাল্যবিবাহ।

Also Read: শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিরা চাইলে একটি বাল্যবিবাহও হবে না