Thank you for trying Sticky AMP!!

মৌলভীবাজারে হাওর এলাকার পথে-হাটে বেচাকেনা হচ্ছে বিপন্ন পাখি

বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসা সরালি, বকসহ অন্যান্য পাখি। শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাশিমপুর বাজারে

এখনো শীত খুব একটা নামেনি। হাওরে পরিযায়ী পাখিদের আসা শুরু হয়নি। তবু দলছুটের মতো যে পাখিরা আসছে, সেই চেনা-অচেনা, বিপন্ন এবং স্থানীয় আবাসিক পাখিরা শিকারির জালে ধরা পড়ছে। হাওরপারের পথে ও হাটে এই পাখিদের প্রকাশ্যে বেচাকেনা চলছে। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের বিভিন্ন পথে ও হাটে এ রকম পাখি কেনাবেচা হতে দেখা গেছে। হাটেই পাখি জবাই করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন কোনো কোনো ক্রেতা।

শুক্রবারের সকাল ছিল কুয়াশায় ঢাকা। মৌলভীবাজারের চাঁদনীঘাট-হলদিগুল সড়ক ধরে যাওয়ার সময় হালকা বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরছিল। ওই সড়কের কাউয়াদীঘি হাওরপারের চানপুর এলাকায় দেখা মিলল দুই ব্যক্তির। তাঁরা হাওর থেকে কিছুক্ষণ আগে ফিরেছেন। একজনের হাতে জাল ও মাছের কাকরাইন (ঝুড়ি)। অন্যজনের হাতে বকের মতো দেখতে খয়েরি-ধূসর রঙের একটি বড় আকারের পাখি ঝুলছিল। তখন সকাল পৌনে সাতটা। গাড়ি থেকে নামতেই তাঁরা জানতে চাইলেন, পাখি কিনব কি না। তিনি নিজে থেকেই দাম চাইলেন ১ হাজার ২০০ টাকা। তিনি জানালেন, আগের রাতে (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) মাছের জালে পাখিটি আটকা পড়েছে। সচরাচর এই পাখি দেখা যায় না। তাঁকে পাখিটি ছাড়া যায় কি না বললে তিনি সরাসরি বলেন, ‘পাখি কেউ ছাড়ার জন্য ধরে নাকি, খাওয়ার জন্যই ধরে।’ এরপর তিনি সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন।

Also Read: নষ্ট হচ্ছে পাখির আবাস–খাবার

ওই স্থান থেকে কিছু দূর যেতেই এ রকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁদের কারও হাতে মাছের ডালা ও ঝুড়ি। মাছ বিক্রির জন্য স্থানীয় বাজারের দিকে যাচ্ছেন তাঁরা। রাতের বেলা এই মাছ ধরেছেন। তাঁদের একজন আড়াল থেকে বের করে নিয়ে এলেন একটা কালেম পাখি। পাখিটির দাম চাইলেন ৭০০ টাকা। এই পাখি বিক্রেতারা জানালেন, তাঁরা মাছের জন্য জাল পাতেন। রাতে সেই জালে পাখি ধরা পড়েছে। মাঝেমধ্যে এ রকম বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ধরা পড়ে।

কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাশিমপুর বাজারের একদিকে কাউয়াদীঘি হাওর, অন্যদিকে কুশিয়ারা নদী। সকাল হলে বাজারটি মাছের ক্রেতা-বিক্রেতায় সরগরম হয়ে ওঠে। শুক্রবারও হাটটি জমজমাট ছিল। বোঝার উপায় নেই তখন অনেক সকাল। অনেক মানুষ তখন হাটে। কুয়াশা যখন কিছুটা হালকা হয়, সূর্যের আলো ফোটে। হাটের বিভিন্ন দিক থেকে হাতে ছোট ছোট ডালায় মাছ নিয়ে আসছেন বিক্রেতারা। পুঁটি, ট্যাংরা, চ্যাং, কই, মাগুর নানারকম ছোট মাছ। নিলামে উঠছে মাছগুলো। সবচেয়ে বেশি টাকা নিলাম ডাকা লোক মাছ কিনে নিচ্ছেন। সেই মাছ নিয়ে শহরের উদ্দেশে ছুটছেন অনেকে। এর মধ্যে একজনকে দেখা গেল এক হাতে একটি কালেম পাখি নিয়ে ঘুরছেন। তিনি মূলত ক্রেতা খুঁজছেন। একসময় ৫০০ টাকায় একজনের কাছে বিক্রি করে তিনি সরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আরও একজন এলেন। তাঁর হাতে সাদা-কালো রঙের ছোট দুটি পাখি। এই পাখির একেকজন একেক নাম বলছেন। কালেম পাখির ক্রেতা এ দুটিও ৩০০ টাকায় কিনে নেন। তবে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একধরনের লুকোচুরি আছে। তাঁরা ভিড় এড়িয়ে এদিক-সেদিক সরে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে বিক্রেতা পাখিগুলো জবাই করে ক্রেতার হাতে দিয়ে টাকা বুঝে নিলেন। এর কিছুক্ষণ পর আরও একজন এলেন, তাঁর দুই হাতে চারটি পাখি। এর একটি সাদা বক, একটি সরালি। বাকি দুটি অচেনা। একটি একদম কুচকুচে কালো। ক্রেতা খুঁজতে খুঁজতে তিনি একসময় ভিড়ে হারিয়ে গেলেন।

Also Read: মুক্ত থাকুক পাখির আবাস 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এখন কাউয়াদীঘি হাওরে আর আগের মতো পাখি নেই। তারপরও মাঝেমধ্যে জেলেদের পাতা জালে কিছু পাখি ধরা পড়ে। রাতের বেলা উড়তে গিয়ে জাল দেখতে পায় না। তখন জালে আটকে যায়। তবে প্রতিদিন হাটে পাখি ওঠে না। শুক্রবারে তুলনামূলক বেশি পাখি দেখা যায়। হাটে প্রকাশ্যে এই পাখি বেচাকেনা হয়।

বিক্রির জন্য জালে ধরা কালেম পাখি হাটে নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার সকাল পৌনে সাতটার দিকে মৌলভীবাজারের চাঁদনীঘাট-হলদিগুল সড়কের চানপুরে

স্থানীয় একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাখি বেচাকেনা দুটোই অপরাধ। ২৫-৩০ বছর আগে আমি নিজেও দোনলা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করেছি। যে চাইত, তাকে দিতাম। পাখি শিকারের নেশা ছিল। একটা সময় মনে হলো, এটা অপরাধ। এটা ঠিক করছি না। সেই থেকে পাখি শিকার ছেড়ে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, যাঁরা পাখি শিকার করেন, তাঁদের মনে কোনো মায়া থাকে না।

পরিবেশকর্মী রাজন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীতে পাখির সংখ্যা বেশি দেখা যায়। শিকারিরা এই সময়ে তৎপর হয়ে ওঠে। হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন বিলে খাবারের সন্ধানে আসা পাখিরা শিকারির ফাঁদে আটকা পড়ে। হাওর-সংলগ্ন বাজারগুলোতে পাখিগুলো বিক্রি করে। গতকাল সকালে কাশিমপুর বাজারে অনেকগুলো পাখি বিক্রি হতে দেখেছি। তিনটি পাখি আমাদের সামনে জবাই করা হলো। সে দৃশ্য এখন পর্যন্ত চোখ থেকে সরাতে পারছি না। পেশাদার-অপেশাদার শিকারিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে পাখিগুলো রক্ষা করা যাবে না।’

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী পরিযায়ীসহ কোনো পাখি হত্যা করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম ছারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউয়াদীঘি হাওরপারের বিভিন্ন এলাকা, হাটবাজারে আমরা কয়েক দিনের মধ্যে সচেতনতামূলক সভা করব। কাশিমপুর বাজারেও গোপন অভিযানসহ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।’