মুক্ত থাকুক পাখির আবাস 

এক জোড়া বিরল পরিযায়ী পাতি মারগেঞ্জারের দেখা মেলে গত ১১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওরে
ছবি: দেবজ্যোতি রায়

এ বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি অতি বিরল একটি পরিযায়ীর দেখা মিলল টাঙ্গুয়ার হাওরে। নাম তার পাতি মারগেঞ্জার। স্বামী-স্ত্রী মিলে টো টো করছিল হাওরে। এই খেচর–দম্পতির দেখা পেয়ে মনে হলো এবার সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ায় অনেক রকম পাখিরই দর্শন মিলবে। ২৯ জানুয়ারি করা হলো পাখিশুমারি। খবর পাওয়া গেল প্রায় অর্ধলাখ হাঁস গোত্রের পাখির। কিন্তু পাতি মারগেঞ্জার ছিল ওই একটি জোড়াই। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালের ৭ মার্চ যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ এলাকায় প্রথম এই পাখির দেখা মিলেছিল। তার প্রায় দুই যুগ পর ওদের দেখা পাওয়া যায় ২০১৮ সালে, উত্তরবঙ্গের জেলা পঞ্চগড়ে।

টাঙ্গুয়ার হাওরে গত ১৪ বছরের পাখি জরিপের ফলাফল নিয়ে সম্প্রতি আমাদের এক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত জার্নাল এভিয়ান কনজারভেশন অ্যান্ড ইকোলজিতে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ৬৯ প্রজাতির জলচর পাখির প্রায় ৫৯ শতাংশ পাখির প্রজাতি দ্রুত হারে কমে গেছে। এর বেশির ভাগই পরিযায়ী। আর ৪১ শতাংশ পাখি কিছুটা হলেও বেড়েছে। এদের বেশির ভাগই আবাসিক।

বলে রাখা ভালো, প্রতিবছর শীতে সারা দেশে যে পরিযায়ী হাঁস আসে, তার অর্ধেকেরই দেখা মেলে টাঙ্গুয়ায়। তাই টাঙ্গুয়ায় পরিযায়ী হাঁস কমে যাওয়া মানে তাদের আবাসস্থল সংকটে পড়েছে।

হাকালুকি হাওরের একটি বড় বিলের নাম হাওরখাল। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে বিস্তৃত হাকালুকির সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বিল এটি। এ বিল ঘিরেই এখন দেশি পাখি শামুকখোলের বড় বিচরণ। একত্রে প্রায় সাত হাজার শামুকখোল। পরিযায়ী পাখি কমে যাওয়ার একটি নিশানা এ শামুকখোলের বেড়ে যাওয়া। পরিযায়ী পাখিদের জায়গা যে দেশীয় জলচর পাখিরা দখলে নিয়ে নিচ্ছে, এর মানে দিন দিন আমাদের বিলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পরিযায়ী পাখির পরিযায়ন রহস্য বের করার জন্য পাঁচ বছর ধরে আমরা কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছি। প্রায় ১০০টি পরিযায়ী হাঁসের গায়ে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে এদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পাখিদের পরিযায়নের দারুণ সব গল্প এখন আমাদের হাতে। আমাদের বেশির ভাগ পরিযায়ী পাখিই তিব্বত, চীন আর উত্তর মঙ্গোলিয়ায় যায় প্রজননকাল কাটাতে। সেসব অঞ্চলে থাকে প্রায় পাঁচ মাস। বাকি সময়টা কাটায় বাংলাদেশে। টাঙ্গুয়া, হাকালুকি আর হাইলের মতো হাওর এলাকা ওদের খুব প্রিয়। তবে এ গবেষণায় বের হয়ে এসেছে যে ছোট ছোট আরও প্রায় অর্ধশত হাওর আর বিলে এরা শীতে আশ্রয় নেয়। এ তথ্য আমাদের অনেকের কাছে একবারেই অজানা ছিল।

ভোলার প্রত্যন্ত উপকূলে শত শত চর আছে। গত শীতে চর শাহজালালে যাওয়ার পথে দেখেছি দাগি রাজহাঁসের একটি বড় দল। এই হাঁসের ওজন প্রায় চার কেজি। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে নেপালের নারায়ণী নদীতে এ রকম একটি দাগি রাজহাঁস দলের দেখা পেয়েছিলাম। এই হাঁস হিমালয়ের ওপর দিয়ে সবচেয়ে উঁচুতে উড়ে রাশিয়ায় গিয়ে প্রজননকাল কাটায়।

সাম্প্রতিক সময়ে হিমালয় ‘গৃধিনী’ নামের একটি পরিযায়ী শকুন নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এই পাখি উড়ে প্রথমে ভারতের হিমাচল প্রদেশে যায়। তারপর চলে যায় ভুটানে। ১০ দিনের মাথায় শকুনটি নেপালের সীমানায় পা রাখে। এখন সেটিকে তিব্বতের একটি অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে পাখিটি গত দুই মাসে পাঁচটি দেশ ভ্রমণ করেছে। ওর ওজন প্রায় ১১ কেজি। হিমালয় এলাকায় সবচেয়ে বড় পাখি এটি।

চামুচঠুঁটো বাটান নামে ৩০ গ্রাম ওজনের একটি পাখি শীতে একটানা ১০টি দেশ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে এসেছে।

পাখির কোনো দেশ নেই। গোটা পৃথিবীই তাদের দেশ। তবে পরিযায়ীদের ভিটেমাটি ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে।

আমাদের পাখির জলাশয়গুলো দিন দিন পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। এ কারণে কমে যাচ্ছে পরিযায়ীদের আবাস। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের প্রকৃতির অংশ। এদের মুক্ত চলাচলে সহায়তা ও আবাস নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

আজ ১৩ মে, বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। ১৪ অক্টোবরও দিবসটি পালিত হয়। এ বছর পরিযায়ী পাখি দিবসের প্রতিপাদ্যে পানি ও পাখির জীবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান রয়েছে। কেবল দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতায় নয়, আজকের দিবসটির মর্মকথা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মধ্যে।