নষ্ট হচ্ছে পাখির আবাস–খাবার

জলচর পাখির বিচরণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ভোলায় পাখির প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র দিন দিন শিকারি, কৃষক ও জেলেদের দখলে চলে যাচ্ছে। 

ভোলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে ভোলখালের পূর্ব তীরে কামাল মিঞার বাগানবাড়িতে কয়েক বছর আগেও সারা বছর কয়েক শ বক, পানকৌড়িসহ নানা জাতের পাখি থাকত। শীতে পাখির সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। বাড়ির সামনে পুকুর আর পেছনে ছিল খাল। ওই বাড়িতে ছিল অসংখ্য গাছপালা। কামাল মিয়া নিজে পাখির পরিচর্যা করতেন। কখনো পাখির ছানা নিচে পড়ে গেলে বাসায় তুলে দিয়ে আসতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর বাড়ির পুকুর ভরাট করা হলো। বাগানের গাছ কাটা হলো, উঠল বহুতল ভবন। ওই এলাকায় এখন আর আগের মতো পাখি দেখা যায়  না। সম্প্রতি কথাগুলো বলেন ভোলা অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের আহ্বায়ক এস এম বাহাউদ্দিন। 

এস এম বাহাউদ্দিন ভোলা শহরের কালীবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। শুধু ভোলায় পাখি কমে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কালীবাড়ী এলাকার এমন কোনো বাড়ি ছিল না যে বাড়ির সামনে পুকুর, বাড়ির পেছনের বাগানে পাখির বসত ছিল না। এখন কোনো বাড়িতে পুকুরও নেই, বাগানও নেই, তাই পাখিও নেই। পাখির আবাস ও খাবার দুটিই নষ্ট হচ্ছে। তাই ভোলা শহরে পাখির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।  

আজ ১৩ মে শনিবার বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। ভোলার জন্যও দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশে যে পরিমাণ পরিযায়ী পাখি আসে, পাখিবিশেষজ্ঞদের মতে, ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকায় আসে তার ৬০ ভাগ। পরিযায়ী পাখি ছাড়াও ভোলার চারপাশের উপকূলে বক, গাঙচিল, পানচিল, পানকৌড়ি, ডাহুক, হট্টিটি, কালোমাথা কাস্তেচড়া, কালেম, শামুকখোল, সরালি, বালিহাঁসসহ ৬৫-৭০ রকমের দেশি জলচর পাখি রয়েছে। 

জলচর পাখির বিচরণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ভোলায় পাখির প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র দিন দিন শিকারি, কৃষক ও জেলেদের দখলে চলে যাচ্ছে। মানুষের অসচেতনতার কারণে পুকুর ভরাট, গাছ নিধনের পাশাপাশি পাখির অভয়ারণ্য হুমকির মুখে পড়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদী থেকে বালু তুলে পুকুর, ডোবা-নালা, কৃষিজমি ভরাট করা হচ্ছে। বাগানের গাছ কেটে বহুতল বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। যত্রতত্র ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে। মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে দিন দিন চাষাবাদ বাড়ছে। অতিরিক্ত ফসল ফলাতে এসব খেতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হচ্ছে। পাখির উৎপাত ঠেকাতে সবজিবাগানে ব্যবহৃত হচ্ছে কারেন্ট জাল। নদীর মধ্যের এসব চরের আশপাশেই নতুন করে ডুবোচর জেগে উঠছে, যেগুলো শীতে ভাটায় জেগে ওঠে। জোয়ারে ডুবে যায়। লোকে একে ডাকে লেচকির চর বা কাদাচর। 

জানা যায়, এসব কাদাচর পাখিদের অভয়ারণ্য। জেলেরা মশারি জাল, কারেন্ট জাল ও নদীর মধ্যে অল্প পানিতে বেহুন্দি জাল পেতে ছোট মাছ শিকার করায় পাখি বসতে পারছে না।  প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অবৈধ জালে পাখির বিচরণক্ষেত্র দখল ছাড়াও পেশাদার শিকারির হাতে নিধন হচ্ছে পাখি। দেশি ও পরিযায়ী পাখির কলরবে মুখর থাকা ভোলার নদী ও সাগরমোহনায় জেগে ওঠা শতাধিক কাদাচর এখন পাখি ও মৎস্য শিকারিদের দখলে। এসব কারণে ভোলায় আশঙ্কাজনক হারে পাখি কমে যাচ্ছে।

দীর্ঘদিন ভোলার পুকুর ভরাট বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করে আসা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘একটি বাড়ি, একটি পুকুর। এটা ছিল ভোলার ঐতিহ্য। ভোলা শহরে গত ২০ বছরে ৪ থেকে ৫ হাজার পুকুর-জলাশয় ভরাট হয়েছে। 

ভোলার উপকূলীয় বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, পুকুর-জলাশয় ভরাট, বড় বড় গাছ কর্তন, কৃষিজমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং কারেন্ট জাল ব্যবহার পাখির আবাস, প্রজননস্থল ও খাদ্য নষ্ট করছে। কারেন্ট জালে শুধু পাখি নিধন হচ্ছে এমন নয়, অনেক বন্য প্রাণী নিধন হচ্ছে। তাঁরা মানুষকে সচেতন করছেন, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। অভিযান ও প্রচারাভিযানের জন্য খরচ বাড়ানো দরকার। 

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্র জানায়, ভোলায় যখন পাখিশুমারি শুরু হয়, তখন শতাধিক প্রজাতির লক্ষাধিক পাখি দেখা যেত। ২০১৩ সালে শুমারি দল ৬৪ প্রজাতির প্রায় ৩৫ হাজার ৫০০টি, ২০১৪ সালে ৬৬ প্রজাতির প্রায় ৪৯ হাজার ৯২৫টি পরিযায়ী পাখি গুনেছে। চলতি বছর ২০২৩ সালে (১৩-২১ জানুয়ারি) শুমারি দল ৬৮ প্রজাতির ৫৩ হাজার ১৮০টি পাখি গণনা করেছে। 

পাখিবিশেষজ্ঞ এনাম আল হক বলেন, বহু বছর ধরে লাখের ওপর পাখিশুমারি করেছি। এক বছর ভোলার কাজীর চর এলাকায় এক ঝাঁকে বসে ছিল এক লাখ চখাচখি (হাঁস)। এখন তো ওই তুলনায় পাখি নেই বললেই চলে।’