Thank you for trying Sticky AMP!!

পাঁচবারের সংসদ সদস্য শম্ভুর তৃতীয় হওয়ার নেপথ্যে যা জানা গেল

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু

বরগুনা শহর থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে নতুন বাসস্ট্যান্ড। দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে নেমে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানে শহরে ফেরার সময় চালক নজরুল ইসলামের কাছে প্রশ্ন ছিল, কেমন ভোট হলো বরগুনায়? নজরুল ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিলেন, ‘মানুষ জিতছে।’ মানে জিজ্ঞাসা করতেই কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘আরে বোঝেন না, মানুষ চাইছে পরিবর্তন। দাদার পরিবর্তন, ভোটে হেইডাই হইছে।’

বোঝা গেল, বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর কথা বলছেন নজরুল ইসলাম। বরগুনার মানুষ তাঁকে দাদা সম্বোধন করেন। ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বরগুনা-১ আসনে সাতবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে ২০০১ ও এবারের নির্বাচন ছাড়া প্রতিবার জিতেছেন তিনি। এবার দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। তিন দশক ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে আছেন শম্ভু।

Also Read: তৃতীয় হয়েছেন সংসদ সদস্য শম্ভু, নাদিরার নিরঙ্কুশ জয়

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বরগুনাবাসীর মধ্যে একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ‘দাদা যত দিন বাঁচবেন, তত দিন তিনি এমপি হবেন।’ তাঁর জায়গায় কেউ দলীয় মনোনয়নও পাবেন না। মনোনয়ন কিংবা পদপদবির প্রতিযোগিতায় তাঁর সঙ্গে কেউ টিকতে পারবেন না—নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এবার ডজনখানেক নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান শম্ভু। তিনি জয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। গত নির্বাচনের সময় তাঁর বিরুদ্ধে নেতারা এককাট্টা হয়েছিলেন। মনোনয়ন চেয়েছিলেন ৫২ জন। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন পান। এবার তাঁর বিরুদ্ধে সাহস করে দলের তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এতেই অকল্পনীয়ভাবে ধরাশায়ী হয়েছেন ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু।

এবারের নির্বাচনে ৬১ হাজার ৭৪২ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গোলাম ছরোয়ার ফোরকান পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৮১৪ ভোট। অন্যদিকে সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য শম্ভু ৫৪ হাজার ১৬৮ ভোট পেয়ে হয়েছেন তৃতীয়।

Also Read: ভোটে ‘কারচুপি ও অনিয়মের’ অভিযোগ দিলেন নৌকার প্রার্থী শম্ভু

নেতা-কর্মীরা জানান, ৩০ বছর ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ আঁকড়ে আছেন শম্ভু। টানা তিনবার সংসদ সদস্য থাকলেও এলাকার উন্নয়নে উদাসীন ছিলেন। পাশাপাশি উদীয়মান ও তরুণ নেতৃত্বকে কোণঠাসা করে নিজের আত্মীয় ও অন্য দলের লোকজনকে পদে বসিয়ে একটি বলয় তৈরি করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পে ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে নির্বাচনে। দলের তরুণ নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ারের কাছে হেরে গেছেন তিনি।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের সময় মানুষ উন্নয়ন, দুর্নীতি, জনসম্পৃক্ততা, কর্মীদের বিপদে-আপদে কে পাশে থাকেন, কে থাকেন না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করেই ভোটের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের প্রার্থীর জনসম্পৃক্ততা না থাকা ও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়ায় মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিলেন। এবার সুষ্ঠু ভোট হওয়ায় সেই পরিবর্তনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তিনি বলেন, বরগুনায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে এক বছর আগে। এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। সহযোগী সংগঠনের কমিটি নেই। নেতা-কর্মীরাও নানা ভাগে বিভক্ত।

Also Read: টাকা ছাড়া নড়েন না শম্ভু

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার

বরগুনার অন্তত ১১ জন ভোটারের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর হেরে যাওয়ার বিষয়ে তাঁদের সবার মন্তব্যই ছিল অভিন্ন। ভোটাররা বলেন, শম্ভু টানা ১৫ বছর সংসদ সদস্য ছিলেন। এ সময়ে তিনি বরগুনার তেমন কোনো উন্নয়ন করেননি। এমনকি মানুষের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগও রাখেননি। তাঁর পরিবার, নিজের লোকদের দুর্নীতি-অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। এবারের ভোটে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

ভোটারদের ভাষ্য, গত ১৫ বছরে পাশের পটুয়াখালী জেলায় অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও বরগুনায় একটিও হয়নি। জেলার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসক-সংকট, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো সবকিছুই বেহাল। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, পাশের জেলায় এত উন্নয়ন হলেও বরগুনায় কেন হলো না। জবাবে শম্ভু বলেছিলেন, ‘পাবে তো না। কারণ, বরগুনা তো পটুয়াখালী বা পিরোজপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলা না।’ তাঁর এ মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তারই প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের ফলাফলে।

Also Read: দুটি গাড়িসহ ছয় গুণ সম্পদ বেড়েছে ধীরেন্দ্র দেবনাথের

নির্বাচনে শম্ভুর শোচনীয় পরাজয়ের পর তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীরা অনেকটাই চুপসে গেছেন। পরাজয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলছেন না। জানতে চাইলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শম্ভুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মুনসি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’ স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হওয়ায় দলে বিভক্তির শঙ্কা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা কেন হবে। কারণ, যিনি জয়ী হয়েছেন, তিনি তো আমাদের দলেরই।’

বিকেলে শহরের কলেজ ব্রাঞ্চ রোড ধরে রিকশায় বটতলা হয়ে ডিকেপি রোডে যাওয়ার পথে ভাঙাচোরা সড়ক। বেহাল সড়কের ঝাঁকুনিতে কাহিল। রিকশাচালক মাহতাব বলছিলেন, ‘এইটা মোগো মেয়র সাইবের বাসার রাস্তা। এই রাস্তার অবস্থাই এমুন। তাইলে বোঝেন বরগুনার অবস্থা কেমুন!’

Also Read: আবারও বরগুনা জেলা আ.লীগের নেতৃত্বে ধীরেন্দ্র দেবনাথ ও জাহাঙ্গীর কবির