প্রধানমন্ত্রীও যাঁকে বাধা দেননি সেই ফারদিনের পার্কে হাঁটায় নিষেধাজ্ঞা
২০১৫ সালের ২ এপ্রিল। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চলছিল অষ্টম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের অনুষ্ঠান। মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্য অতিথিরা বসে আছেন। এ সময় মঞ্চের সামনে দিয়ে আপন মনে হাঁটছিলেন প্রতিবন্ধী এক তরুণ। নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে বাধা দিতে গেলে প্রধানমন্ত্রী বলে উঠেছিলেন, ‘ও হাঁটছে, ওকে হাঁটতে দাও।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেদিন বিনা বাধায় মঞ্চের সামনে হেঁটে বেড়ানোর অনুমতি পেয়েছিলেন মো. এমরান হোসেন ফারদিন। প্রতিবন্ধী ফারদিনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘটনা নিয়ে তখন প্রথম আলোতে ‘ও হাঁটছে, ওকে হাঁটতে দাও: প্রধানমন্ত্রী’ এই শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা। মা জেসমিন মোশাররফের সঙ্গে রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টর পার্কে হাঁটতে গিয়েছিলেন ফারদিন। পার্কে বেঞ্চে বসা এক নারীর হাত ধরে টান দেন ২৮ বছরের এই প্রতিবন্ধী যুবক। তবে বিষয়টি মানতে পারেননি ওই নারী। ঘটনাটি নিয়ে তিনি ক্ষুব্ধ হন।
ফারদিনের মা জেসমিন তখন ওই নারীকে বোঝাতে চান, তাঁর ছেলে প্রতিবন্ধী। খারাপ কোনো কিছু ভেবে তাঁর হাত ধরে টান দেননি। কিন্তু ওই নারীর ক্ষোভ এতে প্রশমিত করা যাচ্ছিল না। পরে তিনি ১১ নম্বর সেক্টর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সহসভাপতি রফিকুল ইসলামকে বিষয়টি জানান। অভিযোগ দেন, এক যুবক (ফারদিন) তাঁর শ্লীলতাহানি করেছেন। লিখিতও অভিযোগ দেন তিনি।
এরপর রফিকুল ইসলাম ফারদিন ও তাঁর মা জেসমিনকে আটকে রেখে একটি অঙ্গীকারনামায় জেসমিনের সই নেন। তাতে লেখা, ফারদিন ও জেসমিন আর কখনো এ পার্কে ঢুকতে পারবেন না।
জেসমিন মোশাররফের অভিযোগ, অঙ্গীকারনামায় সই নেওয়া ছাড়াও তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে পুলিশে দেওয়া, ফারদিনকে বাথরুমে আটকে রাখার হুমকিসহ নানাভাবে তাঁদের হয়রানি করা হয়।
ঘটনার ১১ দিন পর গত মঙ্গলবার বিষয়টি মীমাংসা করার উদ্যোগ নেয় পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। বৈঠকে অভিযোগ করা নারী ও তাঁর স্বামী এবং সোসাইটির সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম ঘটনার জন্য ফারদিনের মা-বাবার কাছে মৌখিকভাবে ক্ষমা চান।
গত বৃহস্পতিবার ফারদিনের মা জেসমিন সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘১১ নম্বর পার্কে ছেলেকে নিয়ে হাঁটছিলাম। ছেলে অটিস্টিক। ডায়াবেটিস আছে। ইনসুলিন নিতে হয়। ১০ নম্বর সেক্টরে আমাদের বাসা, কিন্তু সেখানে পার্ক না থাকায় ছেলেকে নিয়ে ওই পার্কেই হাঁটতে যাই। সেদিন ছেলে বেঞ্চে বসে থাকা এক মেয়ের হাত ধরেছিল। এ অপরাধে সাদা কাগজে সই করতে বাধ্য করা হয় আমাকে। ওই অঙ্গীকারনামায় টাইপ করে লেখা হয়েছে, আমি ছেলেকে নিয়ে আর পার্কে হাঁটতে যেতে পারব না। আমার জীবনে এখন পর্যন্ত এটিই সব থেকে দুঃখজনক ঘটনা।’
জেসমিন আরও বলেন, ‘সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম। ফারদিন অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাঁকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি বারবার তাঁদের অনুরোধও করেছিলাম। কিন্তু আমাদের পুলিশে দেবে, ছেলেকে বাথরুমে আটকে রাখবে বলে হুমকি দিতে থাকে। তখন বলি, আমার ছেলেকে বাথরুমে আটকে রাখার দরকার নেই। সে যে অপরাধ করেছে তার জন্য বরং তাঁকে ফাঁসিতেই ঝুলিয়ে দেন।’
Also Read: ‘ওকে দিয়ে হবে না, ও তো কথা কম বলে’
ফারদিনের বাবা চিকিৎসক এ কে এম মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে যাঁর হাত ধরেছিল, তিনি একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী। মেডিকেলপড়ুয়া একজনের অটিজম সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকবে না, এটা কেমন কথা। সরকার অটিজম সচেতনতায় কত কিছু করছে। আমার ছেলে–স্ত্রীর এভাবে অপমানিত হওয়ার ঘটনা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’
ফারদিনের মা জেসমিন বলেন, ‘অটিস্টিক বাচ্চার বাবা–মায়েরা শখ করে তো সন্তানদের নিয়ে হাঁটতে যান না। ওরাও তো এ দেশের নাগরিক। ওদেরও তো অধিকার আছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ওকে হাঁটতে বাধা দেননি। এখন অঙ্গীকারনামা দিতে হয় যে ছেলেকে নিয়ে পার্কে যেতে পারব না।’
অঙ্গীকারনামায় যা আছে
লিখিত অভিযোগে ওই নারীর স্বামী বলেন, অপরিচিত এক যুবক তাঁর স্ত্রীর হাত ধরে টেনেছেন। তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছেন। তিনি এ ঘটনার বিচার চান। লিখিত অভিযোগে ওপরের অংশে লেখা, অভিযুক্ত যুবক একজন মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি পার্কে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটান। ভবিষ্যতে তিনি যাতে আর এই পার্কে না আসেন, অঙ্গীকারনামা নিয়ে এই বিষয়ে সতর্ক করা হলো।
রফিকুল ইসলাম সোসাইটির সহসভাপতি। অঙ্গীকারনামায় সহসভাপতির নীল কালির সিল ব্যবহার করা হয়। ফারদিনের মা–বাবার অভিযোগের বিষয়ে জানতে এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্ত মুঠোফোনে কল ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।
সোসাইটির সভাপতি আলতাফ হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহসভাপতি অতি উৎসাহী হয়ে যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে আমরা লজ্জিত। তিনি এভাবে সাদা কাগজে অঙ্গীকারনামা নিতে পারেন না। সহসভাপতি এবং অভিযোগ করা ওই নারী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। সহসভাপতি এ-ও কথা দিয়েছেন ভবিষ্যতে এমন আর কোনো ঘটনা ঘটবে না।’
অঙ্গীকারনামা প্রসঙ্গে ফারদিনের বাবা বললেন, ‘আমার ছেলে কথাও বলতে পারে না। অটিস্টিক বাচ্চাদের দেখলে যে কেউ তা বোঝার কথা। অথচ অভিযোগকারী ওই নারী আর সোসাইটির সহসভাপতি সেটা বুঝতে পারলেন না। সাদা কাগজে আমার স্ত্রীর সই নিয়ে তাতে মনগড়া অশ্লীল কথা লিখে রাখলেন। আমার ছেলে অপরাধী নয়, এরপরও তার সঙ্গে তেমন ব্যবহার করা হয়েছে।’
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনি অধিকার
২০১৩ সালে সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে। আইনে ভৌত অবকাঠামো, যানবাহন, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তিসহ জনসাধারণের জন্য প্রাপ্য সব সুবিধা ও সেবায় অন্যদের মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরও সমান সুযোগ ও সমান আচরণপ্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।
আইনে সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা, পার্ক, স্টেশন, বন্দর, টার্মিনাল, সড়কসহ সব গণস্থাপনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। এ ছাড়া এই আইনের অধীনে সংঘটিত যেকোনো অপরাধের জন্য সংক্ষুব্ধ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিজে অথবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মা–বাবা, বৈধ বা আইনানুগ অভিভাবক বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠন মামলা দায়ের করতে পারবেন।
আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে এমন বিষয়
গত ২৬ এপ্রিলের ঘটনা। মেয়ে আল আয়মান ইয়ানাতকে নিয়ে রংপুর নগরের চিকলি ওয়াটার পার্কে যান রিজা রহমান। কিন্তু পার্কের কিডস জোনে হুইলচেয়ারে মেয়েসহ ঢুকতে গেলে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়। ইয়ানাত সেরিব্রাল পালসি নামের মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতের মতো এক রোগে আক্রান্ত।
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে পরদিন ২৭ এপ্রিল রিজা রহমান রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে তিনি ওই পার্কসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে হুইলচেয়ার নিয়ে যাতে যাওয়া যায়, এ ধরনের একটি নির্দেশিকা টানিয়ে রাখারও আহ্বান জানান।
এরপর ৩ মে মেয়েকে নিয়ে রংপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান রিজা রহমান। ২১ মে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের অধীনে পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না—তা জানতে চেয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। ওই পার্কে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ইয়ানাতকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনা নিয়ে আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন দুজন আইনজীবী।
মা–মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা নিয়ে গত ৬ মে প্রথম আলোতে ‘আমার মেয়ের মাথায় কি দুটো শিং গজিয়েছে যে অন্য শিশুরা ভয় পাবে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
Also Read: অটিজম সম্পর্কে জানুন
আরও পড়ুন
-
অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানিয়েছিলেন আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ ও জোসেফ
-
আজিজ আহমেদ বললেন, নিষেধাজ্ঞার ঘটনা সরকারকেও কিছুটা হেয় করে
-
আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আগেই জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
-
ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক
-
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে যেভাবে দেশ ছেড়েছিলেন আজিজ আহমেদের ভাই জোসেফ