Thank you for trying Sticky AMP!!

ওভারপ্যারেন্টিং, স্বপ্নপূরণে জোরজবরদস্তি ও আত্মহত্যা

কয়েক দিন ধরেই পত্রিকার পাতায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আত্মহত্যার খবর বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। আর এই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। যৌবনের যে সময়ে দুরন্ত ষাঁড়ের মতো স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ানোর কথা, হিমালয় ডিঙানো কিংবা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর হওয়ার কথা, সেখানে একবুক হতাশা তাদের—জীবন মাঝপথেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই যেন জ্বলন্ত প্রদীপের সলতে, সন্ধ্যা হতে না হতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু তার তো রাতভর আলো ছড়ানোর কথা ছিল। পৃথিবীকে কত কিছু দেওয়ার ছিল। কত কিছু পাওয়ারও ছিল।

আমি মনোবিজ্ঞানী নই। দর্শনের পাশাপাশি মনোবিজ্ঞান পড়া এবং পড়ানোর সুযোগ হয়েছে। দর্শনের অধ্যাপক এবং শিক্ষার্থী হিসেবে মানুষের মনস্তত্ত্বে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে। মানুষের আচরণের সঙ্গে তাদের বাক্য, চিন্তা এবং পরিবেশ কী ধরনের ভূমিকা পালন করে, সে বিষয় অনেক দিন ধরেই আমার চিন্তার খোরাক জোগায়। কারও আত্মহত্যার খবর শুনলে আমি তাই তার ব্যক্তিগত ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করি।

Also Read: আত্মহত্যা ‘মহামারি’ হয়ে উঠছে কেন

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ আত্মহত্যাকে বেছে নেয় প্রতিশোধ নেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে। সেই প্রতিশোধ হতে পারে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ এবং ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজের প্রতি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ আত্মহত্যা করে একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে একটা সময় কার্যকর করে। বিভিন্ন পর্যায়ে সে তার চারপাশের মানুষকে বিষয়টি বুঝিয়েও দিতে থাকে।

মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো সে যখন তার কোনো চিন্তাকে কর্মে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তখন সে মৌখিকভাবে কিংবা লিখিতভাবে সেটা অন্যের কাছে প্রকাশ করে। তাই কেউ যদি আত্মহত্যার হুমকি দেয় বা আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়, তবে সেই বিষয়টিকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তাঁকে অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে একজন কাউন্সিলর কিংবা মনোবিজ্ঞানীর কাছে পাঠাতে হবে। আশপাশের সবার উচিত হবে তার সঙ্গে সঙ্গ বাড়িয়ে দেওয়া।

সন্তানের সাফল্যে যেমন বাবা-মার গর্বিত হওয়া উচিত তেমনি উচিত সন্তান কোনো কাজে ব্যর্থ হলে তার পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দেওয়া। এই জীবন এক ভ্রমণ। আর আমরা সবাই সেখানে সহযাত্রী। এই যাত্রাপথে কেউ হোঁচট খেলে মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত তার হাত ধরে টেনে তোলা, তাকে ভর্ৎসনা করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া নয়। আসুন, আমরা সবাই এটা উপলব্ধি করি।

আত্মহত্যার একটা বড় কারণ হলো মানসিক অবসাদ বা হতাশা। একটি বয়সের পর বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকাল পার হওয়ার পর ছেলেমেয়েরা নিজেদের নিজস্ব জগতে প্রবেশ করে। তাদের নিজেদের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক চাহিদা তৈরি হয়। তারা তাদের এই চাহিদার বিষয়টি পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। আর এই নিজের প্রয়োজন এবং তা পূরণের উপায় কিংবা তা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে না পেয়ে একধরনের একাকিত্ব কিংবা নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকে। এই নিঃসঙ্গতা কাটাতে অনেক সময় অসৎ সঙ্গ বেছে নেয়, অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। ফলে সে তার জীবনের পথে দিক হারিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই যাত্রাভঙ্গ করে।

অনেকেই মনে করেন, বর্তমানের নিউক্লিয়ার পরিবারতন্ত্র এবং প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনের কারণে মা-বাবারা আর আগের মতো সন্তানকে সময় দিতে পারছেন না। সেখান থেকেও অল্প বয়সীদের মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি হচ্ছে। যার পরিণতিতে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

Also Read: সব কটিই কি আত্মহত্যা?

আমি মনে করি, বাংলাদেশি মা-বাবারা সন্তানের পেছনে যে পরিমাণে সময় ব্যয় করেন, তা পৃথিবীতে বিরল। আমাদের দেশে সকাল হলেই স্কুলের গেটে দেখা যায় অভিভাবকেরা সন্তানের স্কুলব্যাগ বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন আর সন্তান খালি হাতে হেঁটে হেঁটে স্কুলের গেট পর্যন্ত এগিয়ে যাচ্ছে। খাবার টেবিলে সবচেয়ে ভালো খাবারটাই সন্তানের পাতে তুলে দেন বাবা–মায়েরা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাঝখানে সন্তানকে জায়গা দিয়ে রাতযাপন করেন, তাঁদের দাম্পত্য জীবনের অনেক সুখ সন্তান লালন–পালনের জন্য জলাঞ্জলি দেন। খুব কম বাবাই আছেন তাঁর সাবালক সন্তানকে বাজারের দায়িত্ব দিয়ে নিজে আয়েশ করে এক বেলা জানালার রোদ্দুর উপভোগ করেন; সন্তানকে বাজারের ব্যাগ বহন করতে দেন। এ রকম আরও উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাবে যে আমাদের সমাজে সন্তানেরা অনেকাংশে অতি আদরে পরনির্ভরশীল হয়ে ওঠে, সেখান থেকেই তৈরি হয় সমস্যা সমাধানে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি।

উন্নত দেশগুলোর চিত্র কিন্তু একেবারে ভিন্ন। এখানে সন্তান খুব ছোটবেলা থেকে আলাদা বিছানা ব্যবহার করে, নিজের স্কুলব্যাগ নিজে বহন করে, খুব ছোটবেলা থেকেই নিজের হাতে খাবার খাওয়া শেখে, বাজারে গ্রোসারি কার্ট নিজে ঠেলে বাবা–মাকে সাহায্য করে। এতে একদিকে সন্তান যেমন নিজের কাজ নিজে করতে শেখে, নিজে স্বাবলম্বী হয়ে বেড়ে ওঠে, অন্যদিকে জীবনের কঠিনতম সমস্যা সমাধানেও সে ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে। খুব অল্প হোঁচটে জীবনের প্রতি বিমুখ হয় না। ফলে সে আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

Also Read: কেন এত হতাশা? কেন এত আত্মহত্যা?

অন্যদিকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই আমরা স্বপ্ন দেখি সন্তান ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমরা কখনোই একটা বিষয় বিবেচনা করি না যে সন্তান জন্মদানে বাবা–মার ভূমিকা থাকলেও সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীর আলো–বাতাসের মতোই রাষ্ট্রের প্রতিটি বিষয়ে বাবা-মা এবং সন্তান উভয়ের অধিকার সমান। এটি অনেকেই বোঝেন না বা বুঝতে চান না।

আমাদের দেশের বাবা–মায়েদের মধ্যে ‘ওভারপারেন্টিং সিনড্রোম’ লক্ষণীয়। আর এই ওভারপারেন্টিংয়ের কারণে সন্তানের ওপর অতিরিক্ত নজরদারি এবং নিজের স্বপ্নপূরণে সন্তানকে বাজি রাখতে তাঁরা দ্বিধা করেন না। ফলে জেনে বা না জেনে নিজেদের অজান্তেই সন্তানের ওপরে স্বপ্নপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেন। চিন্তা করেন না, যে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা বহন করার মতো সক্ষমতা সন্তানের আছে কি না।

যে মা নিজের সোনামণিকে একটা স্কুলব্যাগ বহন করতে দিতে চান না, যে বাবা আদরের সন্তানকে বাজারের ব্যাগ বহন করার কষ্ট দিতে চান না, নিজেদের অজান্তেই তারা সন্তানের ওপর অসহনীয় মাত্রার মানসিক বোঝা চাপিয়ে দেন। ফলে মা-বাবার প্রত্যাশা প্রাপ্তিতে পরিণত করতে ব্যর্থ হলে এক দিকে যেমন সন্তান নিজে হতাশায় ভোগে, অন্যদিকে তার ভেতরে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে। সেই সঙ্গে বাবা-মা বা পরিবারের অসহযোগিতা তার কাছ থেকে যাপনের সুখ কেড়ে নেয়। সন্তান হতাশায় পর্যবসিত হয়। অতএব কোনো অবস্থাতেই সন্তানের জীবনকে নিজের জীবন ভেবে নিজের স্বপ্ন তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত না।

আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে কখনোই গুরুত্ব দিই না। আমরা সামান্য সর্দি–কাশি কিংবা জ্বর হলে চিকিৎসকের কাছে ছুটি—ওষুধ এবং পথ্যের পসরা সাজিয়ে বসি। কিন্তু শরীরের পাশাপাশি মনের স্বাস্থ্যের প্রতিও আমাদের সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেই বিষয়টি আমরা কখনোই আমলে নিই না।

Also Read: প্রতিটি আত্মহত্যায় প্ররোচনার পেছনে আছেন আপনি, আমিও

আমরা মনে করি, সাইকোলজিস্ট কিংবা সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হওয়া মানেই হলো নিজেকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা। অথচ বিষণ্নতা কিংবা মানসিক অবসাদের অনেক সমস্যা সামান্য কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনে ওষুধ সেবনেই সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে। ফলে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগবিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে জরুরি মনোরোগবিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীদের আধুনিক শিক্ষা এবং উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা এবং ট্রেনিং। এই পেশাকে আকর্ষণীয় করার জন্য তাদের জন্য বিশেষ বেতন স্কেল এবং পেশাগত সুবিধা প্রদান এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, জীবন খুব মূল্যবান। একটি পরিবার, একটি সমাজ কিংবা একটি দেশ হলো একটি ফুলের বাগানের মতো। একটি বাগানে যেমন নানা প্রজাতির ফুল শোভা পায়, কিছু ফুল রং কিংবা গন্ধের মাদকতায় কীটপতঙ্গ এবং পথচারীকে আকৃষ্ট করে, কিছু ফুল বর্ণ কিংবা গন্ধহীন হয়েও বাগানের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তেমনি একটি পরিবারের প্রতিটা সন্তানই সেই পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজের কোনো পেশাই ছোট নয়। সমাজ থেকে শ্রেণিবৈষম্য দূর করে বেঁচে থাকাকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি মানুষের সে তার পরিবার এবং সমাজের জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ সেই মানসিকতা পোষণ করতে হবে। সন্তানের সাফল্যে যেমন বাবা-মার গর্বিত হওয়া উচিত তেমনি উচিত সন্তান কোনো কাজে ব্যর্থ হলে তার পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দেওয়া। এই জীবন এক ভ্রমণ। আর আমরা সবাই সেখানে সহযাত্রী। এই যাত্রাপথে কেউ হোঁচট খেলে মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত তার হাত ধরে টেনে তোলা, তাকে ভর্ৎসনা করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া নয়। আসুন, আমরা সবাই এটা উপলব্ধি করি।

  • নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা।

    ই–মেইল: nsultana79ju@gmail.com