প্রতিটি আত্মহত্যায় প্ররোচনার পেছনে আছেন আপনি, আমিও

পেশাদার সংবাদমাধ্যম এবং আমাদের বোঝা উচিত, আমরা যা করছি, যেভাবে করছি, তার সঙ্গে একটা মানুষের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া জড়িত।

অভিনাথ মারানডি আর রবি মারানডির মতো একেবারে সাধারণ, প্রান্তিক মানুষকে আমাদের চেনার কথা ছিল না। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ‘বোরো ধানের জমিতে পানি না পেয়ে’ কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা তাঁদের চিনিয়েছে দেশবাসীর কাছে। বাংলাদেশের আর সব ক্ষেত্রের মতো জমিতে সেচের ক্ষেত্রেও আমরা দেখলাম প্রতাপশালীদের দাপটে টেকে না ‘সাধারণ’ মানুষ।

মারানডিদের এ ঘটনার আগে এক কিশোরীর হাতে লেখা একটি সুইসাইড নোটের ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মূল ধারার মিডিয়ায়ও সুইসাইড নোটের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই কিশোরী আত্মহত্যার কারণ হিসেবে লিখেছিল, ‘ও আমার সাথে খুব খারাপ কিছু করছে বলার মতো না।’ এর কিছুদিন আগে আরেক আলোচিত আত্মহত্যার ঘটনায় ফেসবুক লাইভ এসে আত্মহত্যা করার আগে ‘আত্মহত্যার কারণ’ জানিয়েছিলেন একজন চলচ্চিত্র অভিনেতার শ্বশুর।

সাম্প্রতিক সময়ের এই চাঞ্চল্যকর আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর কারণ জেনেছি আমরা। কিন্তু সব সময় সেটা ঘটে না। অনেক সময়ই আত্মহত্যাকারী কোনো সুইসাইড নোট রেখে যান না, কিংবা কাউকে বলে জান না আত্মহত্যার কারণ। তখন অনিবার্যভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়—কেন?


আত্মহত্যার কারণ নিয়ে একটা তথ্য জানলে এবং সেটায় আস্থা আনলে প্রতিবার হয়তো আমাদের এই কৌতূহল হতো না। পৃথিবীর সব আত্মহত্যার কারণ স্রেফ একটা। হ্যাঁ, আপনি ভুল পড়েননি। আত্মহত্যার একমাত্র কারণটি নিয়ে কথা বলব কলামের শেষের দিকে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। মানে প্রতিদিন ৩০ জনের বেশি। আত্মহত্যার বৈশ্বিক হারের (প্রতি লাখে ১০ জন) তুলনায় বাংলাদেশের আত্মহত্যার হার তুলনামূলকভাবে কম (প্রতি লাখে ৬.৫ জনের বেশি)। তবে এটাও সত্য, বাংলাদেশের সব আত্মহত্যার খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় না, তাই প্রকৃত সংখ্যা হতে পারে এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের জন্য আরও বড় আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, প্রতিবছর বৈশ্বিক আত্মহত্যার হার ক্রমান্বয়ে যখন কমে আসছে, আমাদের আত্মহত্যার হার বাড়ছে। আত্মহত্যা কেন বাড়ছে, কীভাবে সেটা কমিয়ে আনা যায়, সেসব নিয়ে মনোবৈজ্ঞানিক, সমাজতাত্ত্বিক নানা দিক থেকে আলোচনা পর্যাপ্ত না হলেও হচ্ছে। অবশ্য আমার এই কলামের বিষয় একটু ভিন্ন একটা দিক নিয়ে।
আমরা যে ভাষায় মিডিয়ায় আত্মহত্যার খবর দেই, কিংবা যে ভাষায় আমরা নিজেদের মধ্যে কারও আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করি, আত্মহত্যাকে আমরা আমাদের সাহিত্যে, শিল্পে, সিনেমায় যেভাবে দেখানোর চেষ্টা করি, সেটার দিকে কি আমরা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছি? আমরা হয়তো খেয়ালই করি না আমাদের প্রতিটা সংবাদে, কিংবা আমাদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমরা আত্মহত্যাকে একধরনের যৌক্তিকতা নিজেদের অজান্তেই দিয়ে দিই।

‘বখাটের অত্যাচারে স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা’, ‘লজ্জায় ধর্ষিতার আত্মহত্যা’, ‘দাম্পত্য কলহের জের ধরে চট্টগ্রামে চিকিৎসকের আত্মহত্যা’, ‘বিচ্ছেদ, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রেমিকের আত্মহত্যা’, ‘দারিদ্র্য সইতে না পেরে আত্মহত্যা’, ‘মাস্টার্স পাস বেকার যুবকের আত্মহত্যা’, ‘ঋণের বোঝা সইতে না পেরে গৃহবধূর আত্মহত্যা’, ‘সরকারি চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় যুবকের আত্মহত্যা’—এ সবই এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিকের আত্মহত্যার খবরের শিরোনাম। আত্মহত্যা, বাংলাদেশ এসব ট্যাগ দিয়ে গুগলে সার্চ করলেই দেখা যাবে আমাদের প্রতিটা সংবাদের বিস্তারিত এবং হেডলাইনের একটা বিশেষ ধরন আছে। প্রতিটা সংবাদে এটা যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এভাবে, যে মানুষটা আত্মহত্যা করেছেন তিনি কত কষ্ট ছিলেন এবং সেই কষ্টের কারণে তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।

আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য-প্রমাণ আছে যে আত্মহত্যার সংবাদ মিডিয়াতে যত বেশি পরিমাণে আসে এবং সেটা যদি অসংবেদনশীল ভাষায় লেখা হয় এবং আমরা যদি সেটাকে ভুলভাবে আলোচনা করি, তাহলে সেটা আরও বহু মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। বিশেষ করে একই রকম পরিস্থিতিতে পড়া মানুষের একই ভাবে আত্মহত্যা (কপিক্যাট সুইসাইড) করার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।

আমরা নিজেরাও যখন জাতীয়ভাবে আলোচিত কিংবা আমাদের পাশে ঘটা কোনো আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করি, ঠিক এভাবেই আলোচনা করি। অর্থাৎ সবাই মিলে আমরা এমন একটা হাইপোথিসিস সমাজে দাঁড় করাই যে জীবনে এমন কোনো পরিস্থিতি আছে, যেখানে আত্মহত্যা করা যায়। আসলেই কি আছে তেমন কিছু?

এখন পর্যন্ত শুধু একটা ক্ষেত্রে মানুষ তার নিজের জীবনের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে এ রকম আলোচনা হচ্ছে। এটা হচ্ছে ‘অ্যাকটিভ ইউথ্যানাসিয়া’। অর্থাৎ কোনো মানুষ যদি এমন রোগে আক্রান্ত হয়, যার প্রভাবে সে খুব কম সময় বাঁচবে, কিন্তু সেই সময়টাও সে প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাবে—এমন ক্ষেত্রে একজন মানুষ তার নিজের স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে পারবে। ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে সংঘাত থাকলেও এটা নিয়ে পৃথিবীতে এ মুহূর্তে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। কানাডা, নেদারল্যান্ডস ও কলম্বিয়া অ্যাকটিভ ইউথ্যানাসিয়াকে আইনগত ভিত্তি দিয়েছে। এর বাইরে মানুষের আত্মহত্যা করার মতো পরিস্থিতি নেই—এটা নিয়ে বড় ধরনের ঐকমত্য আছে।

পৃথিবীতে বেশ কিছু খুব ভালো মানের গবেষণা হয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে, আত্মহত্যার খবর আমরা যেভাবে পরিবেশন করি, সেটা অন্য মানুষের আত্মহত্যা করার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই আত্মহত্যার খবর মিডিয়াতে কীভাবে দেওয়া হবে, সেই ব্যাপারে একটা দিকনির্দেশনা আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। আজকের যুগে মিডিয়া বলতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া নয়, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও আছে।

আত্মহত্যার খবর মিডিয়ায় দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা এ রকম—
(১) আত্মহত্যার বর্ণনায় এমন ভাষা ব্যবহার করা কোনোভাবেই উচিত নয়, যেটা আত্মহত্যাকে সমস্যার একটা সমাধান হিসাবে দেখায়, আত্মহত্যাকে চাঞ্চল্যকর করে তোলে, কিংবা এটাকে খুব স্বাভাবিক ঘটনা বানিয়ে ফেলে, (২) আত্মহত্যার সংবাদ পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাখা যাবে না, (৩) সংবাদে একটা আত্মহত্যা বা আত্মহত্যা চেষ্টার স্থান এবং পদ্ধতি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা থাকবে না, (৪) খুব সতর্কভাবে হেডলাইনের ভাষা ব্যবহার করতে হবে এবং সেখানে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি বাদ দিতে হবে, (৫) ছবি বা ভিডিও না দেওয়াই উচিত হবে, দিলেও সে ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং (৬) সেলিব্রিটিদের আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সেটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত হবে না, যাতে সেটা তাঁকে গৌরবান্বিত করে।

আরও পড়ুন

আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য-প্রমাণ আছে যে আত্মহত্যার সংবাদ মিডিয়াতে যত বেশি পরিমাণে আসে এবং সেটা যদি অসংবেদনশীল ভাষায় লেখা হয় এবং আমরা যদি সেটাকে ভুলভাবে আলোচনা করি, তাহলে সেটা আরও বহু মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। বিশেষ করে একই রকম পরিস্থিতিতে পড়া মানুষের একই ভাবে আত্মহত্যা (কপিক্যাট সুইসাইড) করার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।

বদ্ধ জায়গায় চারকোল পুড়িয়ে তারপর সেখানে কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের মাধ্যমে আত্মহত্যার একটা চর্চা শুরু হয়েছিল তাইওয়ানে। এই আত্মহত্যার খবরগুলো যখন পত্রিকায় বিস্তারিতভাবে আসতে শুরু করল, তখন দেখা গেল সে দেশের আত্মহত্যার সংখ্যা তো বেড়েছেই, সঙ্গে বহু আত্মহত্যাকারী ব্যবহার করছিলেন চারকোলের ওই পদ্ধতি। পরে একই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে হংকং, চীন ও জাপানেও।

সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখব একই রকম ঘটনার প্রবণতা আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে। কোনো কাঙ্ক্ষিত মানুষকে ফোনে অথবা ভিডিও কলে রেখে কিংবা ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার খবর আমরা খুব বিস্তারিতভাবে (অনেক ক্ষেত্রেই ছবিসহ) প্রকাশ করছি। এ কারণে এই ধরনের ঘটনা এখন বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

আত্মহত্যার সংবাদটি যদি হয় কোনো সেলিব্রিটির, তাহলে সেটার প্রভাব আরও বড় হয়। মার্কিন চলচ্চিত্র তারকা রবিন উইলিয়ামসের আত্মহত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। চীনা অভিনেত্রী রুয়ান লিংগিউ, জাপানি মিউজিশিয়ান ইউকিকো ওকদা, হিদেতো মাতসিমতো, কোরিয়ান অভিনেত্রী চই জিন শিল, সর্বোপরি মার্কিন অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যার খবর মিডিয়ায় বহুল প্রচারের পর আত্মহত্যার সংখ্যায় উল্লম্ফন হয়েছিল।

শুধু বাস্তবের মানুষই নয়, সাহিত্য বা সিনেমার ক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রবণতার অনেক পুরোনো ইতিহাস পাওয়া যায়। গ্যাটের উপন্যাস ‘দ্য সরোজ অব ইয়াং ওয়ার্থার’–এর মূল চরিত্র ওয়ার্থার এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল যে বহু মানুষ সেই চরিত্রের মতো করে পোশাক পরত। কিন্তু এটা তৈরি করেছিল একটা বড় বিপদও। প্রেমিকাকে পেতে ব্যর্থ হয়ে ওয়ার্থার শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন, যেটা অনেক মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। আমাদের দেশের মূল ধারার বাণিজ্যিক সিনেমায় নারী ধর্ষিত হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে, এমন দৃশ্য খুব সাধারণ বিষয় ছিল। এর সামাজিক প্রভাব কী, আমার আদৌ কখনো ভেবেছিলাম?

আরও পড়ুন

শুরুতে বলেছিলাম, আত্মহত্যার কারণ স্রেফ একটি। হ্যাঁ, গবেষণায় দেখা গেছে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে মানসিক অসুস্থতা বা মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে। এই মানসিক ভারসাম্যহীনতা ঘটতে পারে জীবনের কোনো সংকট কিংবা মাদকাসক্তি থেকে। বাকি আর যা–ই বলা হোক না কেন, কোনোটিই আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ নয়। এটা বোঝা যায় খুব সহজেই, একই রকম পরিস্থিতিতে কিংবা তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে অসংখ্য মানুষ তো আত্মহত্যা করছে না। এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীনতার যে পর্যায়ের একটা মুহূর্তের সিদ্ধান্তে মানুষ আত্মহত্যা করে, সেটা পার হয়ে গেলে এবং পর্যাপ্ত মানসিক সেবা পেলে প্রায় সব ক্ষেত্রে সে মানুষটি আর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন না।

আমাদের অনেকের অবাক লাগবে জেনে, মানসিক অসুস্থতাকে মূল কারণ হিসেবে দেখানো গেলে আত্মহত্যার অনুকরণ করার সম্ভাবনা কমে যায়। বিখ্যাত মিউজিক ব্যান্ড নির্ভানার সদস্য কার্ট কবিনের আত্মহত্যার পর আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়েনি। কারণ, সেই ঘটনার রিপোর্টে কবিনের মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ করা হয়েছিল।

আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া একটা ফৌজদারি অপরাধ আমাদের দেশে। সেটাকে দূরে সরিয়ে রেখেও যদি বলি কোনো একটা আত্মহত্যার সঙ্গে আমাদের নাম যদি কোনোভাবে জড়িয়ে যায়, সেটা অন্ততপক্ষে ভীষণ অনৈতিক। আত্মহত্যার খবর পরিবেশনে মিডিয়া এবং আমরা নিজেরাও যেভাবে অসতর্ক থাকি, তাতে প্রতিটি আত্মহত্যার আশঙ্কায় আমাদেরও অবদান থাকে, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। মানে আমরাও আত্মহত্যায় প্ররোচিত করি। পেশাদার মিডিয়া এবং আমাদের বোঝা উচিত, আমরা যা করছি, যেভাবে করছি, তার সঙ্গে একটা মানুষের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া জড়িত।

জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক