কেন এত হতাশা? কেন এত আত্মহত্যা?

ইদানীং পত্রিকা খুললেই তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আত্মহত্যার খবর খুব বেশি চোখে পড়ছে। সপ্তাহ কয়েক আগে বরিশালের এক তরুণ ঢাকায় আসার পথে মাঝনদীতে চলন্ত লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর এই আত্মহত্যা করার পুরো দৃশ্যটাই দেশের অনেক মানুষ দেখেছেন সিসি-ক্যামেরার ভিডিওর মাধ্যমে। এই ঘটনার পর ছেলেটার খুব কাছের একজন বন্ধু বলেছেন, চাকরি না পাওয়ার কারণে সে হতাশায় ভুগছিলেন। সব সময় বলতেন, বয়স তো বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই তো হচ্ছে না। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেও ভাইভায় বাদ হয়ে যেতেন। অনেক জায়গা থেকে আবার ডাকতও না। এই জন্য তিনি হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন।

দেশে বেকার তরুণ-তরুণীর সংখ্যা আসলে কত? কোথাও কি কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আছে? এই বেকার তরুণদের মধ্যে কত ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করা; এর কি কোনো হিসাব আছে? কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করে ছেলেমেয়েগুলো শেষ পর্যন্ত কী করছেন, এর পরিসংখ্যানই বা কোথায় পাওয়া যাবে? সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও দেশে যে বেকারের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে, এটি কিন্তু সহজেই অনুমান করা যায়।

আরও পড়ুন

আরেক তরুণ রাশিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে এসে একটা বায়িং হাউসে চাকরি করছিলেন। তাঁর পরিবার জানিয়েছে, ভালো একটা চাকরি হচ্ছিল না বলে তাঁর মধ্যে হতাশা কাজ করছিল। তিনি মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যার কারণে তাঁকে চিকিৎসাও নিতে হয়েছে। এই তরুণও শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর তো একটা চাকরি ছিল। সে তো পুরোপুরি বেকার ছিলেন না। এরপরও কেন আত্মহত্যা করেছেন?

কারণ, সামাজিক একটা চাপ হয়তো তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। বিদেশ থেকে পড়ে এসেছেন। কিংবা অনার্স-মাস্টার্স পাস করে ভালো চাকরি না করলে সমাজের মানুষেরা বলে বেড়ায়—‘এত পড়াশোনা করে তাহলে কি লাভ হলো!’, ‘অমুকে তো ভালো চাকরি করছেন। তোমার হচ্ছে না কেন’ ইত্যাদি।

সমস্যা কিন্তু এখন দুভাবে প্রকট আকার ধারণ করছে। একদল চাকরিই পাচ্ছে না। বেকার হয়ে বসে আছে। আরেক দল চাকরি হয়তো পেয়েছে, কিন্তু তারা মনে করছে, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পায়নি। ধরন দুই রকম হলেও এই দুই দলের তরুণ-তরুণীরাই ভীষণ হতাশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যা বহুল দেশে বেকার সমস্যা থাকবে। এটি খুব স্বাভাবিক বিষয়। তাই আমাদের এমন কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে, যাঁরা স্রেফ ডিগ্রি নেওয়ার জন্য পড়বেন না, বরং কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাবেন। যাঁরা যেকোনো কাজ করতে কার্পণ্য করবে না। এতে বেকার সমস্যার যেমন কিছুটা হলেও সমাধান করা সম্ভব। সেই সঙ্গে হতাশা থেকেও তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েগুলো বের হয়ে আসতে পারবেন।

এই যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই। একেক সময় শুনি একেক জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এর কি আদৌ দরকার আছে? আমাদের কি আদৌ এই পরিমাণ অনার্স-মাস্টার্স পাস করা কর্মী বাহিনীর দরকার আছে? তাহলে কেন আমরা এত এত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছি? চাকরির বাজারে গিয়ে তাঁদের অনেকেই চাকরি পাচ্ছেন না। অন্যরা আবার ভালো চাকরি না পেয়ে হতাশায় ডুবছেন। কারণ, তাঁদের মধ্যে একটা ইগো কাজ করছে, আমরা অনার্স-মাস্টার্স পাস! আমরা কেন সাধারণ চাকরি করব। সমাজ তাঁদের মধ্যে এই প্রেশারটা চাপিয়ে দিচ্ছে।

তাই দেশে এত এত বিশ্ববিদ্যালয়ের বোধ করি দরকার নেই। এর চাইতে বরং কারিগরি শিক্ষায় আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। এতে দুই ধরনের সুবিধা। তাঁরা টেকনিক্যাল বিষয়ে পারদর্শী হবেন। সহজে চাকরি পাবেন। দেশে চাকরি না পেলেও বিদেশে আমরা তাঁদের দক্ষ কর্মী হিসেবে পাঠাতে পারব। কিংবা তাঁরা নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে পারবেন। বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যা বহুল দেশে বেকার সমস্যা থাকবে। এটি খুব স্বাভাবিক বিষয়। তাই আমাদের এমন কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে, যাঁরা স্রেফ ডিগ্রি নেওয়ার জন্য পড়বেন না, বরং কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাবেন। যাঁরা যেকোনো কাজ করতে কার্পণ্য করবে না। এতে বেকার সমস্যার যেমন কিছুটা হলেও সমাধান করা সম্ভব। সেই সঙ্গে হতাশা থেকেও তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েগুলো বের হয়ে আসতে পারবেন।

  • ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: [email protected]