Thank you for trying Sticky AMP!!

‘খেলা হবে’

ষাট-সত্তরের দশকে বক্সার মোহাম্মদ আলী দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। একটা আপাত–নৃশংস খেলাকে তিনি শিল্পে রূপ দিয়েছেন। বক্সিং এমনিতেই পশ্চিমের অনেক দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় খেলা। বক্সিং রিংয়ে মোহাম্মদ আলীর আবির্ভাব খেলাটিকে সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয় করেছে।

তখন দেখেছি, খেলা শুরু হওয়ার আগে রিংয়ের মধ্যে যুযুধান দুই বক্সার গ্লাভস পরা হাত ঊর্ধ্বে তুলে পরস্পরের বিরুদ্ধে তর্জন–গর্জন করছেন, ভয় দেখাচ্ছেন। শরীরের ভাষা দেখে মনে হতো, একজন হয়তো আরেকজনকে বলছেন, আজ তোকে মেরেই ফেলব। আসলে এটা খেলারই অংশ। মূল পর্বে যাওয়ার আগে মানসিক চাপ আর ভীতি তৈরি করা। তারপর পনেরো রাউন্ডের খেলায় হারজিতের ফয়সালা হতো। কেউ হয়তো তার আগেই কয়েক রাউন্ডের মধ্যে ধরাশায়ী হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বিদায় নিত।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে বক্সিং রিংয়ের হাওয়া লেগেছে। সামনে মূল খেলা, অর্থাৎ নির্বাচন। তার আগেই শুরু হয়ে গেছে হম্বিতম্বি। এটা নতুন নয়। আগেও হয়েছে। কিন্তু এবার উত্তাপটা যেন একটু বেশি।

এসব দেখে মোটাদাগে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় মানুষের মধ্যে। অনেকেই আতঙ্কিত হন। আবার কেউ কেউ বিনোদন পান। সাধারণত যাত্রাপালায় কিছু নট-নটী থাকেন। তাঁরা আস্তিন গুটিয়ে, গলার রগ ফুলিয়ে, কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়িয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এসবই অভিনয়। এ জন্য পেশাদার নট-নটীরা টাকা পান, হাততালিও পান।

কিন্তু রাজনীতি কি অভিনয়? শুনতে পাই, এটা নাকি একটি মহান ব্রত। দেশের ও দশের চিন্তায় যাঁদের ঘুম আসে না, আহার-নিদ্রা ভুলে যান, তাঁরাই নাকি রাজনীতি করেন। বিরোধী দলে থাকলে গ্রেপ্তার হন, জেল খাটেন। একটা সময় ছিল, তখন জেলে যাওয়াকে খুব সম্মানের চোখে দেখা হতো।

বলা হতো রাজবন্দী। জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় ঘোষক তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে কমপক্ষে এক ডজন বিশেষণ ব্যবহার করতেন। তাঁর মধ্যে এটা বলতে ভুলতেন না, কারা নির্যাতিত নেতা। কে কত বছর জেলে ছিলেন, তার ভিত্তিতে মাপা হতো কে কত বড় ত্যাগী নেতা। ছাত্রজীবনে একটা বই পড়েছিলাম—জেলে ত্রিশ বছর। লেখক ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। তাঁকে সামনাসামনি দেখেছি। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। পরে জেনেছি নেলসন ম্যান্ডেলার কথা।

এখন দেশে আর রাজবন্দী নেই। বিরোধী দলের রাজনীতি করে যারা একবার সরকারে যেতে পারে, তারা তাদের বিরোধীদের ধরে ধরে জেলে ঢোকায় আর বলে, এরা রাজবন্দী নয়, এরা ক্রিমিনাল। জেলে নেওয়ার আগে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদের নামে যথেচ্ছ পেটানো হয়। শুনেছি, এরও নানান মাত্রা আছে—দুই ডিগ্রি, তিন ডিগ্রি, চার ডিগ্রি ইত্যাদি। এ ছাড়া পিটিয়ে মেরে ফেলার উদাহরণ তো আছেই। অর্থাৎ আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই বিচার করে ফেলা।

রাজনীতিবিদেরা অহরহ বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এই বচনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সব রকমের সুবিধাবাদ। মানুষ নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। নাগরিকদের জিম্মি করে ‘খেলা হবে’ জিগির তুলে যাঁরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন, তাঁদের বোঝাবে কে? ইশপের গল্পের সেই মোরাল মনে পড়ে গেল—তোমাদের কাছে যা খেলা, আমাদের কাছে তা মৃত্যু।

বক্সিং রিংয়ে মূল খেলা শুরুর আগে কেউ কারও গায়ে হাত তুললে শাস্তি পেতে হয়। রেফারি সেখানে খুব কড়া। শাস্তি হিসেবে নানা মেয়াদে খেলায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, এমনকি আজীবনের জন্যও।

রাজনীতি এখন একটা বক্সিং রিং। কিন্তু রেফারি নেই। যাঁদের রেফারি হওয়ার কথা, মনে হয় তাঁরা নিজেরাই খেলোয়াড় হতে পছন্দ করেন। আমজনতা কেবলই দর্শক। তারা কী ভাবল, তাতে কিছু যায়–আসে না।

পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই সরকারের শীর্ষ মহল থেকে আমরা হম্বিতম্বি শুনে অভ্যস্ত। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান তাঁর প্রতিপক্ষ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন—শের কুচাল দেঙ্গা। মানে, মুণ্ডু কেটে ফেলব।

কী ভয়াবহ কথা! এ কথা কি নবাবজাদার মুখে শোভা পায়? আরেক প্রতিপক্ষ এ কে ফজলুল হককে বলা হলো ভারতের দালাল। এ ধরনের অমার্জিত ভাষা শুনতে শুনতে আমরা পার করেছি ২৪ বছর। তারপর বাংলাদেশ হলো। আমরা স্বাধীন হলাম। এখন আমরা মুখে যা খুশি তা–ই বলতে পারি। আমরা তো স্বাধীন!

নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে আস্ফালন, খিস্তিখেউড়। পাকিস্তানি শাসকদের অমার্জিত কুবচনগুলো এখন আমাদের নেতাদের মুখে। এ যদি বলে মাঠে আছি, ও বলে রাস্তা ছাড়ি নাই। এ যদি বলে শেষ না দেখে ঘরে ফিরব না, ও বলে আমরা বের হলে তোমরা পালানোর পথ পাবে না।

Also Read: দল নিয়ে নেতারা চিন্তিত, দেশটাকে বাঁচাবে কে

আর অভিযোগের তো অন্ত নেই। পরস্পরকে চোর, সন্ত্রাসী, খুনি, দেশ বিক্রয়কারী—কত রকম কথা বলে! তাদের কাছ থেকে আমাদের শিশুরা কী শিখবে?

বছরখানেক ধরে একটা বচন হাওয়ায় ভাসছে—খেলা হবে। এটা এখন ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’য় বেশ ‘জনপ্রিয়’ মনে হচ্ছে। রাস্তার বখাটেরা বিশেষ কিছু শব্দ ব্যবহার করে। এই শব্দগুলো এখন আমাদের অনেক রাজনীতিবিদের ঠোঁটের আগায়। যেভাবে তাঁরা পরস্পরের প্রতি শব্দবাণ ছুড়ে দিচ্ছেন, তাতে মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছে। আর যাদের খাওয়া-পরার চিন্তা নেই, গাঁটে টাকার অভাব নেই, তারা অনেকেই আছে খোশমেজাজে। গন্ডগোল একটা লাগলে সেখান থেকে ফায়দা লোটার ফিকির করে কেউ কেউ। এদের বলা হয় মহারথী।

একটি বিরোধী দল নানান শহরে জনসমাবেশ করছে একের পর এক। এতে তারা অনেক দৃশ্যমান হচ্ছে। সরকারি দল দেখছে, মাঠ না আবার হাতছাড়া হয়ে যায়। তারাও নেমে পড়েছে। শহরের মধ্যে একটা জমায়েত মানে সারা দিনের জন্য রাস্তাঘাট অচল হয়ে যাওয়া। কাজের লোককে রুটিরুজির জন্য বেরোতেই হয়। তার কথা ভাবার সময় নেই এদের। মাঠেই সবকিছুর ফয়সালা করা চাই। এই শোডাউনের রাজনীতির ভিকটিম হলো সাধারণ মানুষ।

হায়দারি হাঁক শোনা যাচ্ছে, ডিসেম্বরে নাকি খেলা হবে। আমরা এত দিন মুখিয়ে ছিলাম নভেম্বর-ডিসেম্বরে খেলা দেখব, কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল। আমাদের দেশের ফুটবল তো এখন তলানিতে। অন্য দেশের খেলা দেখেই আমরা সান্ত্বনা পাই। হলুদ–সবুজ আর সাদা-নীল পতাকায় ছেয়ে যাবে এখানকার বাড়িঘরের ছাদ, শহরে ও গাঁয়ে। সেটা ছাপিয়ে এখন রাজনীতির ফুটবল খেলার মহড়া চলছে দেশে। এখানে বল হলো আমজনতা। সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে তারা যে কী আনন্দ পায়, একমাত্র তারাই জানে।

শুনেছি, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে। আশঙ্কা হচ্ছে, নির্বাচন আদৌ হবে কি না। সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে নির্বাচন না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। আমরা সবাই গণতন্ত্রী, কিন্তু তালগাছটা আমার—কারও মনে এই ধান্দা থাকলে নির্বাচন করে লাভ কী?

নির্বাচনে তো রেফারিগিরি করবে নির্বাচন কমিশন। সেটা শুরু হবে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করার সময় থেকে। এখন তারা ব্যস্ত ইভিএম নিয়ে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন কমছে। কর্তাদের স্তোকবাক্যে ভরসা রাখা যাচ্ছে না। সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ইভিএমের জন্য গরিব মানুষের টাকায় মেশিনপত্র কেনার এই নবাবি বিলাসিতা কেন?

Also Read: পরিবহন ধর্মঘট কেন রাজনৈতিক হাতিয়ার

গাইবান্ধায় ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করাতে গিয়ে কী হলো? মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হলো। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার উপায় বের না করে মেশিন কিনে কী হবে? দুষ্ট লোকে বলে, এখানে নাকি বিশাল বাণিজ্যের ব্যাপার আছে। আমার জানতে ইচ্ছা করে, মেশিন কাদের কাছ থেকে কিনে কোন ঠিকাদার এগুলো কমিশনকে সরবরাহ করবে।

রাজনীতিবিদেরা অহরহ বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এই বচনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সব রকমের সুবিধাবাদ। মানুষ নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। নাগরিকদের জিম্মি করে ‘খেলা হবে’ জিগির তুলে যাঁরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন, তাঁদের বোঝাবে কে? ইশপের গল্পের সেই মোরাল মনে পড়ে গেল—তোমাদের কাছে যা খেলা, আমাদের কাছে তা মৃত্যু।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক