দল নিয়ে নেতারা চিন্তিত, দেশটাকে বাঁচাবে কে

দেশ মহাসংকটে। নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। ডলারের অভাবে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে শিল্পকারখানা দিনের লম্বা একটা সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে শিল্পকারখানার সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এর আগে তাঁরা জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে বসেছেন। কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেননি কবে নাগাদ এলএনজি আমদানি করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে না। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে দিনের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হতে পারে। 

এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আঘাত হানায় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। দেশে প্রতিবছর একাধিকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। কিন্তু সেই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের টেকসই কোনো কর্মসূচি আছে বলে মনে হয় না। মাস কয়েক আগে সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল ডুবে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হলো। বন্যা হয়েছে উত্তরাঞ্চলেও। আগে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াত। সাধ্যমতো সাহায্য করত। এখন রাজনৈতিক দলগুলো সারাক্ষণ ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকে। মানুষকে সহায়তা করার সময় কোথায় তাদের?

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব দলীয় নেতা-কর্মীদের ঘূর্ণিঝড়দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেছিল। কজন গেছেন, জানি না। বাড়িঘর ও ফসল হারানো নারী-পুরুষ আহাজারি করছেন। এরই মধ্যে ডেইলি স্টার-এ খবর দেখলাম, ঘূর্ণিঝড়দুর্গত ভোলার চরফ্যাশনে যুবদলের নেতা-কর্মীরা সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আলমের বাড়িতে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করতে একত্র হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলা চালিয়ে ৫০ জনকে আহত করেন।

কেবল ভোলা নয়, ৫ নভেম্বর বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশ নিয়ে পুরো বিভাগে টানটান উত্তেজনা। এ হামলা তারই পূর্বাভাস বলে ধারণা করি। প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন, মহাসড়কে নছিমন, করিমন ইত্যাদি চলাচল করার প্রতিবাদে পরিবহনমালিকেরা ধর্মঘট ডেকেছেন। তাঁদের কিছু করার নেই। এখন তাঁরা নতুন তত্ত্ব হাজির করেছেন। বিএনপির সমাবেশে সহিংসতা হতে পারে, এই ভয়ে পরিবহনমালিকেরা পরিবহন বন্ধ রাখছেন। জল, স্থল ও অন্তরিক্ষে আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড দাপটের মধ্যে বিএনপি সমাবেশ ডেকে সহিংসতা করবে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না। 

আসলে বিএনপিকে গণসমাবেশের অনুমতি দিয়ে সরকার প্রমাণ করতে চাইছে তারা গণতান্ত্রিক। আবার বিএনপির সমাবেশে যাতে বেশি লোক না হয়, সে জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তারা দেখতে চাইছে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেনি। এই অপকৌশল ও জবরদস্তিতে যে সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে আসে, সেই সত্যটি কোনো দল ক্ষমতায় থাকতে বিশ্বাস করে না। ক্ষমতার বাইরে গেলে তাদের বোধোদয় হয়। 

ব্রিটেনে গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুবার প্রধানমন্ত্রী বদল হলো। বরিস জনসন আস্থা ভোটে হেরে গেলে লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে তিন সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগ করেন। এরপর আসেন ঋষি সুনাক। তিনি দায়িত্ব নিয়েই অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য পূর্বসূরির সমালোচনা করেননি। আগেরবার যাঁরা তঁার প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা দিয়েছিলেন, তঁাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক কথাও বলেননি। কিংবা বক্তৃতা দিতে উঠেই বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত করেননি। কেবল বলেছেন, এই জাতীয় সংকট নিরসনে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

রংপুরে বিএনপির গণসমাবেশ আজ ২৯ অক্টোবর। গতকাল শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে আজ শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে রংপুর জেলা বাস মালিক সমিতি। কারণ হিসেবে তারা মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচল বন্ধসহ কয়েকটি দাবির কথা উল্লেখ করেছে। বগুড়া থেকে রংপুর বিভাগের ১০টি রুটে বাস চলাচল গতকাল সকাল ছয়টা থেকে আজ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী থেকে রংপুরগামী বাস চলাচল দুই দিন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর আগেই বরিশালে বিএনপির সমাবেশের দিন ও এর আগের দিন অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বাসমালিকদের সংগঠন বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপ। তারাও কারণ হিসেবে মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যান ও ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল বন্ধের দাবির কথা বলেছে।

ময়মনসিংহে (১৫ অক্টোবর) কর্মসূচির দিন ধর্মঘট ডাকা না হলেও বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে বাধা দেন। এরপর খুলনায়ও (২২ অক্টোবর) কর্মসূচির দুই দিন আগে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। সমাবেশ ও পরিবহন ধর্মঘট সমান্তরালভাবে চলছে। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার বলেছেন, জনসমাগম কাকে বলে তা বিএনপিকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কীভাবে বুঝিয়ে দেবেন? আওয়ামী লীগও আজ শনিবার ঢাকায় সমাবেশ ডেকেছে। শেরেবাংলা নগরে, আগে যেখানে বাণিজ্য মেলা হতো। বিএনপি গণসমাবেশ করছে সুষ্ঠু নির্বাচন ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে। আওয়ামী লীগ ঢাকায় সমাবেশ করে নিজেদের শক্তি দেখাতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের শক্তি তো দেশবাসী ১৪ বছর ধরেই দেখে আসছে। ঢাকা শহরে এ রকম একটি সমাবেশে মানুষের কী পরিমাণ ভোগান্তি হবে, তা কি জনদরদি নেতারা একবার ভেবে দেখেছেন? 

যখন দেশ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর এই পাল্টাপাল্টি কেন? বিরোধী দলের সমাবেশ সামনে রেখে এ রকম পরিবহন ধর্মঘট-অবরোধ নতুন নয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। আর পরিবহন ধর্মঘটের কারণে এই খাতের অনিয়মিত শ্রমিকেরা ওই সময়ে মজুরিও পাবেন না। তঁাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

অন্যান্য বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করার পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির এক নেতা ১৬ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ চলবে বলে আগাম ঘোষণা দিয়েছেন। বিপরীতে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ডিসেম্বরে বিএনপিকে রাস্তায় নামতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এই যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি হুঁশিয়ারি, এতে জনগণের কী লাভ? 

কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক  সবুজবাগ থানা ও কয়েকটি ওয়ার্ডের সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন—এগুলো বন্ধ করেন।...টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন, টাকাপয়সা নিয়ে কমিটি গঠন—এই প্র্যাকটিস চিরতরে বন্ধ করতে হবে।’ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেছেন, পদ-বাণিজ্য এখন সবচেয়ে বড় লাভজনক ব্যবসা। ক্ষমতায় আসার ১৪ বছর পর নেতাদের মুখে এই আক্ষেপ ও হুঁশিয়ারি কী ইঙ্গিত দেয়? দল ও সরকারের সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলেনি, চলছে না। 

বিএনপির নেতারাও বলছেন, এবার আন্দোলনে জয়ী হতে না পারলে দলের অস্তিত্ব থাকবে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন নিয়ে এ রকম নিরন্তর লাঠালাঠি হানাহানি হওয়ার দ্বিতীয় নজির নেই।

আরও পড়ুন

ব্রিটেনে গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুবার প্রধানমন্ত্রী বদল হলো। বরিস জনসন আস্থা ভোটে হেরে গেলে লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে তিন সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগ করেন। এরপর আসেন ঋষি সুনাক। তিনি দায়িত্ব নিয়েই অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য পূর্বসূরির সমালোচনা করেননি। আগেরবার যাঁরা তঁার প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা দিয়েছিলেন, তঁাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক কথাও বলেননি। কিংবা বক্তৃতা দিতে উঠেই বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত করেননি। কেবল বলেছেন, এই জাতীয় সংকট নিরসনে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবাই মানে বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে নয়। এখানেই আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে তঁাদের গণতন্ত্রের ফারাক। 

আমাদের নেতারা দল নিয়ে অতিশয় চিন্তিত। কিন্তু দেশটাকে বাঁচানোর কথা ভাবেন না।  

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]