Thank you for trying Sticky AMP!!

মেসির স্বপ্নপূরণের মুহূর্ত

যে রাতে মেসি ‘আর্জেন্টাইন হেভেনে’ চিরন্তন হলেন

রবার্তো ফুনতানারোজা তাঁর ‘এন আর্জেন্টাইন’স হেভেন’ গল্পে কয়েকজন বন্ধুর কথা লিখেছিলেন। যাঁরা একদিন বারবিকিউ পার্টিতে জড়ো হয়ে ফুটবল নিয়ে আলাপ করতে করতে হঠাৎ লক্ষ করলেন, তাঁরা সবাই মারা গেছেন। তবে আকস্মিক এ মৃত্যুর পরও সবাই দারুণ আনন্দিত। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস, মানুষ যখন পোড়া মাংস খেতে খেতে ফুটবল নিয়ে আলোচনা করে, এর অর্থ তারা তখন স্বর্গে আছে।

ফুনতানারোজার এই গল্প থেকে ফুটবল নিয়ে আর্জেন্টাইনদের প্রেম ও পাগলামি কিছুটা হলেও আন্দাজ পাওয়া যায়। এটা নিছক গল্প হলেও কখনো কখনো বাস্তবতা এসব গল্পকথাকেও ছাপিয়ে যায়। ৩৬ বছর ধরে বিশ্বকাপহীন থাকা একটা দেশ যখন বহু আরাধ্য ট্রফির জন্য হাহাকার করতে থাকে, তখন তাদের এমনই কিছু গল্পকথা তৈরি করতে হয়। কারণ, মানুষ নিজের অস্তিত্বকে এসব মিথ ও উপকথার ভেতর দিয়েই জীবিত রাখে। ধরে রাখে নিজের সংস্কৃতি। কারণ, তারা এটাও বিশ্বাস করে যে একদিন গল্পকথা বা রূপকথার দিন ফুরোবে। যেদিন বাস্তবতাই হয়ে উঠবে রূপকথার অধিক কিছু।

তেমনই একটা রাত ঠিক এক বছর আগে নেমে এসেছিল আর্জেন্টাইনদের জীবনে। কাতারের লুসাইলে সে এক আশ্চর্য রাত। যে রাত ১২ মাস ধরে প্রতিদিনই অদ্ভুত এক ‍তৃপ্তি নিয়ে এসেছে আর্জেন্টাইন নাগরিক এবং বিশ্বব্যাপী তাঁদের সমর্থকদের জীবনে। যেন সেই এক রাতের রেশ পৃথিবীর বুক থেকে কিছু মানুষের জন্য আর কখনোই ফুরোবে না। আর সেই রাতের পর একজন মানুষ সেই ‘আর্জেন্টাইন হেভেনে’ চিরকালীন ও চির উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে গেছেন। সেই মানুষটার নাম লিওনেল মেসি। আর্জেন্টাইন ফুটবল–আকাশে এর আগে নক্ষত্র ছিল একটা। ৩৬ বছর ধরে যেখানে রাজত্ব করেছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামের এক জাদুকর। কিন্তু ১৮ ডিসেম্বর থেকে ‘কিং ডিয়েগো’র সঙ্গে শাশ্বত হয়ে গেছেন মেসিও।

একটা বিশ্বকাপ জেতার আশায় নিজের জীবনটাই যেন বাজি ধরতে রাজি ছিলেন মেসি। কী করবেন, ৬ হাজার ১৭৫ গ্রামের সোনার ট্রফিটি ছাড়া রোজারিওর সোনার ছেলের শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছিলেন অনেকে! ক্রুশবিদ্ধ যোদ্ধার মতো একটা বিশ্বকাপ জেতার আশায় ইউরোপ, আফ্রিকা, এমনকি নিজ মহাদেশেও চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু সোনার ট্রফির বদলে সব জায়গাতেই ধরা দিয়েছে লা মাঞ্চার ‘দন কিহোতে’র মতো মরীচিকা। শেষ পর্যন্ত শেষবারের মতো এলেন এশিয়ায়। এবার নয়তো আর কখনোই নয়। জিততে না পারলে চিরকালীন নায়ক হওয়ার বদলে মিলবে শুধুই একজন ট্র্যাজিক হিরোর মর্যাদা।

Also Read: যারা সব জিতেছে আমি তাদের একজন, বললেন মেসি

এশিয়া ফেরায়নি মেসিকে, ফেরায়নি কাতার। সেখানেই লেখা হলো আশ্চর্য এক রাতের গল্প। আর এভাবেই সাধারণ একটি দিন ১৮ ডিসেম্বরও অমর হয়ে গেল ক্যালেন্ডারের পাতায়, আর্জেন্টিনা ও বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে।

প্রশ্ন হচ্ছে, মেসি কি কখনো এমন ‘রোলার কোস্টার’ জীবন চেয়েছিলেন? তিনি তো চেয়েছিলেন পারানা নদীতে ধীরগতিতে ভেসে যাওয়া জাহাজগুলোর মতো আয়েশি জীবন। চেয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে লেপার ডে উদ্‌যাপন করতে করতে জীবনটাকে উড়িয়ে দিতে। ‘গড ইজ রাউন্ড’ বইয়ের লেখক হুয়ান ভিলোরোর মতে, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন আর্জেন্টাইনদের জাতীয় চরিত্রের ঠিক উল্টো। যারা এক ট্যাঙ্গোর ওপর ভর করে গোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন, মেসি ঠিক তেমন ছিলেন না।

ক্রুশবিদ্ধ যোদ্ধার মতো একটা বিশ্বকাপ জেতার আশায় ইউরোপ, আফ্রিকা, এমনকি নিজ মহাদেশেও চষে বেড়িয়েছেন মেসি

আর্জেন্টাইনদের মেলোড্রামাটিক জীবনযাত্রার অনেক কিছু ছিল তাঁর জীবনে অনুপস্থিত। এমনকি যখন তিনি ট্যাটু করতে গেলেন, তখন ম্যারাডোনার মতো চে গুয়েভারা বা কোনো বিখ্যাত মানুষের মুখ তিনি বেছে নেননি। তিনি বেছে নেন নিজের মায়ের মুখ। প্রতিবার গোলের পর তিনি আকাশের দিকে তাকান নানিকে স্মরণ করে। এমনই সাদামাটা।

Also Read: বিশ্বকাপ জয়ের গল্প শুনিয়েছেন মেসি

কিন্তু শান্ত এই মানুষটির কাছ থেকে জীবনের চাওয়া ছিল ভিন্ন। জীবনই তাঁকে নামিয়ে দেয় অদ্ভুত এক লড়াইয়ে। যে লড়াই প্রথমে তাঁকে শুরু করতে হয়েছিল জীবনের শুরু থেকে। কিন্তু সেই হরমোনজনিত সমস্যা যেন শাপে বর হলো। যা তাঁকে নিয়ে যায় বার্সেলোনার লা মাসিয়ায়। এরপর বাকিটা আর কখনো পেছনে না তাকানোর গল্প। যে গল্পের শরীরে গেঁথে ছিল অসংখ্য কাঁটা। সেই কাঁটাগুলো তুলতে তুলতে মেসি জীবনকে টেনেছেন প্রায় ৩৬ বছর। যে বয়সও প্রায় আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ না জেতার সমান। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতে নিজেকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে আর্জেন্টাইনদেরও যেন মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছেন মেসি।

এশিয়া ফেরায়নি মেসিকে, ফেরায়নি কাতার। সেখানেই লেখা হলো আশ্চর্য এক রাতের গল্প।

সম্প্রতি অ্যাপল টিভি প্লাসের ‘মেসি’স ওয়ার্ল্ড কাপ: দ্য রাইজ অব আ লেজেন্ড’ নামের প্রামাণ্যচিত্রের টিজারের এক জায়গায় বলতে শোনা যায়, ‘মেসি ইজ আর্জেন্টিনা, আর্জেন্টিনা মেসি।’ আক্ষরিক অর্থেই ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বরের পর থেকে বিষয়টা এমনই। আর্জেন্টিনা ও মেসি যেন একবিন্দুতে এসে মিশে গেছে।

Also Read: ‘টাইম’–এর বর্ষসেরা অ্যাথলেট মেসি

যে আর্জেন্টাইনরা একদিন মেসির দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁরাই মেসিকে একপলক দেখার জন্য বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় মানব ঢল হয়ে নেমে আসেন। সেই মেসির নামেই রোজারিওতে শহরের নাম করার প্রস্তাব আনা হয়। আর্জেন্টাইন রেডিওতে শোনানো হয় ‘মেসি ও তাঁর স্যুটকেস’–এর গল্প। যে গল্পে আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত লেখক হারনান কাসসিয়ারি বলেছেন, ‘দুই ধরনের অভিবাসী আছেন।

একধরনের হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা স্পেনে পৌঁছে নিজেদের স্যুটকেস আলমারিতে উঠিয়ে রাখেন এবং যাঁরা বাইরে রাখেন। দ্বিতীয় দলের হচ্ছেন সেই মানুষগুলো, যাঁরা নিজেদের শিকড় ভুলতে পারেন না। মেসি সেই দ্বিতীয় দলের একজন। যিনি তাঁর গাউচো উচ্চারণ অক্ষুণ্ন রেখেছেন।’

মেসিরা বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে আর্জেন্টিনায় পৌঁছানোর পর বুয়েনস এইরেসে জনতার ঢল

রোজারিওতে বসে রেডিওতে এই গল্প শুনতে শুনতে চোখ ভিজে আসে মেসি ও তাঁর স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোর। হয়তো এই গল্পের ভেতর দিয়ে পুরো জীবনটাকেই দেখে ফেলেছিলেন মেসি। জীবন এমনই। কে জানে বিশ্বকাপ জিততে না পারলে মেসির গল্পটা এমন হতো কি না। সেই ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ জিততে না পারার বেদনার ভার মেসিকে টানতে হয়েছে ২০২২ পর্যন্ত। কাতারে ট্রফিটা হাতে না উঠলে হয়তো সেই বেদনাই সঙ্গী হতো বাকি জীবনে। কিন্তু দুই দশক ধরে যিনি ফুটবলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন, ফুটবলও তাঁকে খালি হাতে ফেরাতে চায়নি। যাওয়ার আগে সবটাই বুঝিয়ে দিয়েছে কড়ায়-গন্ডায়। তাই মেসি এখন বলতে পারেন, ফুটবলের কাছে আমার কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই।

Also Read: ভালোবাসার শহরে বিশ্বকাপ ট্রফি আর মেসির না ভোলার রাত

অথচ একদিন এই মেসিই বাথরুমে আটকে পড়ার পর দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন পছন্দের বাইসাইকেলের লোভে। ভিলোরো লিখেছেন, ‘সে যখন খেলা শুরু করে, এটা জানার কোনো উপায় নেই যে কোথায় গেলে তাকে ধরা যাবে। আমরা যা জানি, তা হলো, এমন কোনো তালা নেই, যা তাকে আটকে রাখতে পারে।’

আর এভাবেই বিশ্বকাপ ট্রফির কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত শত বাধাও তাঁকে আটকাতে পারেনি। আর মেসি যখন ঠিক সেই ট্রফির কাছে গিয়ে পৌঁছালেন, মুহূর্তের মধ্যে তিনি চিরন্তন হয়ে গেলেন।

Also Read: রোমাঞ্চের রাত শেষে মেসির জাদুকরি ভোর