ছোট মামার চোর ধরা

মা-মা-মা...তীব্র চিত্কার! চমকে ওঠে অপূর্ব। কাঁচা আমের শরবত গলা দিয়ে নামতে গিয়ে যেন আটকে যায়। খকখক করে দুবার কাশে। হাতে থাকা শরবতের গ্লাস টেবিলে রেখে জানতে চায়, ‘কী কী হয়েছে রে? অমন বিকট চিত্কার করছে কে?’

আমি নির্বিকার কণ্ঠে জানালাম, ‘চিত্কার নয়, ছোট মামা গলা সাধছেন।’

অপূর্ব চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মানে উনি গান গাইছেন? তুই ঠিক জানিস?’

‘না, ঠিক গান গাইছেন না। তবে সেই উদ্দেশ্যেই গলা সাধছেন।’

‘ওই হলো, একই কথা। কিন্তু গানের সঙ্গে যে সুর বলে একটা ব্যাপার থাকে, সেটা বোধ হয় তোর মামা জানেন না। আর গলাই যদি সাধেন তো শুধু মা-মা বলে চিত্কার করছেন কেন?’

অপূর্ব আমার বন্ধু। আজ শুক্রবার ছুটির দিন, তাই সে এসেছে আমাদের বাসায়। দুই বন্ধু জমিয়ে আড্ডা দেব। এর মধ্যেই মামার বেসুরো চিত্কার। এ নিয়ে ওর সঙ্গে কথা শেষ না হতেই মামা আবারও ‘মা মা’ শুরু করলেন। নাহ্, আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার কিছু একটা করতেই হয়। বন্ধুর সামনে মানসম্মান বলে কিছু থাকল না। বিরক্ত মুখে গেলাম মামার ঘরে। মামা সেখানে হারমনিয়াম নিয়ে কসরত করছেন। সেই সঙ্গে নাক-মুখ বিকৃত করে মা মা বলে চিত্কার। আমাকে দেখে অবশ্য থামলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে পোনা, তুইও গান শিখবি নাকি? মন্দ হবে না। দুই মামা-ভাগনে একসঙ্গে গলা সাধব।’

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ‘মামা, তোমার গলা সাধা আজকের মতো বন্ধ রাখা যায় না?’

‘কেন? আপা কিছু বলেছে নাকি?’

‘না, মা কিছু বলেনি। আমিই বলছি। আচ্ছা, তুমি শুধু মা মা মা করছ কেন বলো তো?’

মামা মুচকি হাসলেন। হারমনিয়ামটা ঠেলে কিছুটা দূরে সরিয়ে বললেন, ‘শোন, গান হলো সাত সুরে বাঁধা। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি। তো “মা” স্বরটা আমার গলায় ঠিকমতো লাগছিল না। তাই ওটা বারবার চর্চা করছিলাম। গান কি এতই সহজ? কষ্ট করলে তবেই না কেষ্ট মেলে।’

মামা কষ্ট করছেন, না আমাদের কষ্ট দিচ্ছেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে আমি আর সেদিকে গেলাম না। মামাকে বিষয়টা খুলেই বললাম, ‘দ্যাখো মামা, আমার এক বন্ধু এসেছে। সে তোমার এমন গলা সাধার সঙ্গে পরিচিত নয় কি না, তাই ওর একটু সমস্যা হচ্ছে। এবেলা নাহয় আর না-ই কষ্ট করলে।’

মামা তার স্বভাব অনুযায়ী হঠাৎ রেগে গেলেন, ‘তোদের জেনারেশনের এটাই সমস্যা। হাইস্কুলে উঠেছিস, তো ভেবে নিয়েছিস বিশাল বড় হয়ে গেছি। এখন মন চাইলেই পাকা পাকা কথা বলা যায়। তোর ওই বন্ধু গানের কী বোঝে? ও কি জানে আমি একবার দেশাত্মবোধক গান গেয়ে পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছিলাম?’

ছোট মামার সেই পুরস্কারের গল্প এ বাড়ির সবারই মুখস্থ। সেটা মামার স্কুলজীবনের ঘটনা। ঈদের পর পাড়ায় পুনর্মিলনী-জাতীয় একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। তারই একটা পর্বে ছিল দেশাত্মবোধক গানের প্রতিযোগিতা। আরও কয়েকজনের সঙ্গে মামাও নাম দিয়েছিলেন। তবে এটা ভাবেননি যে শেষ পর্যন্ত সত্যিই তাকে গাইতে হবে। যখন তার নাম মাইকে ঘোষণা করা হলো, মামা অনুষ্ঠানস্থল থেকে পালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিচ্ছু বন্ধুবান্ধব থাকলে যা হয়, সবাই মিলে ধরে তাকে মঞ্চে তুলে দিল। তখন দেখা দিল আরেক ভয়াবহ সমস্যা, ভালো-মন্দ তো পরের কথা, মামার কোনো গানই মনে পড়ছিল না! উপস্থাপক ও বিচারকদের বারবার অনুরোধের মুখে মামা শেষ পর্যন্ত একটি গান গেয়েছিলেন। আর সেটা ছিল আমাদের জাতীয় সংগীত। এদিকে ঘটনাচক্রে অন্য তিন প্রতিযোগীর কেউই উপস্থিত ছিল না। ফলে একমাত্র প্রতিযোগী হিসেবে মামা একটা পুরস্কার পেয়েছিলেন বটে! মামা অবশ্য গল্পটা অনেক রং চড়িয়ে বলেন।

একটু থেমে মামা আবার বলেন, ‘তোর বন্ধু তো এটাও জানে না যে, আমি গান গেয়ে চোর পর্যন্ত ধরে ফেলতে পারি।’

এবার আমাকে অবাক হতেই হলো। মামার বাহাদুরির অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু এটা তো কখনো বলেননি। এর মধ্যে অপূর্ব কখন আমার খোঁজে এ ঘরে এসে পড়েছে তা বুঝতেই পারিনি। আর মামার তো বোধ হয় দুনিয়ার কোনো দিকেই খেয়াল নেই।

জানতে চাইলাম, ‘চোর ধরার বিষয়টা কী মামা?’

আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে মামা শুরু করলেন, ‘এটা আমার পুরস্কার পাওয়ার আগের ঘটনা। তখন আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংগীতচর্চা করতাম। একদিন আজকের মতোই গলা সাধছিলাম, হঠাৎ শুনি ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দ। পরক্ষণেই ওরে বাবারে, মরে গেলাম বলে চিত্কার ভেসে এল। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি এক লোক মাটিতে পড়ে ব্যথায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি গিয়ে বললাম, কী হয়েছে ভাই? সে তো ভয়ানক ক্ষিপ্ত। আমাকে বলল, “বজ্জাত ছেলে, তোমার জন্যই এই দশা।” আমি তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একটু পরই অবশ্য রহস্য খোলাসা হয়েছিল। লোকজনের জেরার মুখে সে স্বীকার করে, চুরির উদ্দেশ্যে এ বাড়িতে ঢুকেছে। আমাদের আধাপাকা ঘরের ঘুলঘুলি ছিল বেশ বড়। জানালার কার্নিশে বসে সেই ঘুলঘুলি খোলার চেষ্টা করছিল সে। এরপর সেই পথে ঘরে ঢুকে দামি জিনিসপত্র হাপিস করার মতলব ছিল। এর মধ্যে আমি যখন রে-রে বলে গলা সাধছিলাম, সে ভেবে নেয় তাকে দেখতে পেয়ে আমি চিৎকার করছি। পরে আমি যখন “মা” শুরু করেছি, সে ভেবেছে আমি মাকে ডাকছি চোর ধরার জন্য। সে পালাতে যাবে, এ সময় আমি “পা” স্বর ধরেছি। আর চোর ধরে নেয়, তার পায়ে কিছু হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে পা দেখতে গিয়ে সে কার্নিশ থেকে পড়ে যায়। পরে লোকজন তাকে ধরে পুলিশে দেয়।’

মামার বীরত্বগাথা শুনে আমি হাসব না কাঁদব, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না! অপূর্বরও বোধ হয় তখন একই অবস্থা। মামাকে তার ‘সংগীতচর্চা’র সুযোগ দিয়ে আমরা ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।