অজগর স্যার ও চন্দ্রা

অলংকরণ: মেহেদী হক
অলংকরণ: মেহেদী হক

মানহাদের বিজ্ঞান স্যার আজগর সাত্তার, খুবই রাগী ধরনের মানুষ। পড়ানোর সময় ভয়ংকর সব মুখভঙ্গি করে চোখমুখ কুঁচকে কথা বলেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ঠোঁট সরু করে জিবটা বারবার বের করেন, ফলে তাঁর আরেক নাম হয়ে গেছে অজগর স্যার। তাঁর মূল সমস্যা হলো, তিনি বিজ্ঞানে যা-ই পড়ান, পড়ানোর পরে ক্লাসের সবার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এইগুলা ভুয়া কথা। বাইরের বিজ্ঞানীদের বুজরুকি। পরীক্ষার জন্য পড়তেসো পড়ো, বিশ্বাস করা লাগবে না।’ আর কেউ কিছু জানতে চাইলেই উল্টো ধমক দেন। বলেন, ‘আসছে আমার আইনস্টাইন! বইতে যা আছে পড়ো।’

ক্লাসে এখন পেটানো নিষেধ, কিন্তু এই স্যার মুখে কথা বলে যা করেন, তা পেটানোর চেয়ে কম নয়।

মানহাদের ক্লাসের কেউই স্যারকে পছন্দ করে না। নাফিসা, জিশান, রাবিদ সবাই বিরক্ত। বিজ্ঞান বিষয়টার ওপরই তাদের বিরক্তি এসে গেছে। একদিন হঠাৎ ক্লাসে নতুন এক মেয়ে ভর্তি হলো। মেয়েটা অদ্ভুত। ক্লাস ফাইভের কারও তুলনায় বেশ ঢ্যাঙ্গা, গায়ের রং খয়েরি ধরনের, কান দুটি কেমন বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকে। প্রথম দিন মেয়েটা কারও দিকে তাকালই না, পুরোটা সময় মুখ নিচু করে বসে থাকল। বেশি ভাব নিচ্ছে মনে করে মানহাও পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করল। পরের দিনও একই অবস্থা। তার পরের দিন মানহা ঠিক করল, এই মেয়েকে সে জীবনেও নাম জিজ্ঞেস করবে না, ঢঙি একটা। কিন্তু সেদিন ক্লাসে ঢুকেই যা ঘটল...!

সেদিনও অজগর স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন, মানুষের চাঁদে অভিযানের কথা পড়াচ্ছিলেন। আর্মস্ট্রং কীভাবে চাঁদে নেমেছেন, সেটা পড়ার পরই তিনি বইটা বন্ধ করে বললেন, ‘কী দুর্ভাগ্য, এই সব বুজরুক পোলাপানদের পড়াতে হচ্ছে। চাঁদে কি মানুষ যাইতে পারে? আর এইটা এখন ইন্টারনেটেও প্রমাণ করছে যে চাঁদে আসলে মানুষ যায় নাই। এই সব মিথ্যা-টিথ্যা আমাদের পড়তে হইতেছে। আফসোস! তোমরাই বলো, শূন্যে আবার রকেট ওড়ে কীভাবে? সেইখানে বাতাস আছে? এমনেই তো টুপ কইরে সেটা পড়ে যাওয়ার কথা, কী বলো সবাই?’

 ‘জি স্যার!’ অজগর স্যারের সঙ্গে গলা না মেলালে পরিণাম আরও খারাপ হতে পারে।

 ‘সেটাই, এইগুলা হলিউডে বানানো সিনেমা। তোমরা চাইলে আমার মোবাইলে দেইখা যাইতে পারো। মানুষ ওইভাবে হালকা লাফ দিয়া দিয়া হাঁটতে পারে কখনো?’

‘জি না স্যার!’ আবার সবাই বলল। অজগর স্যার হাসিমুখে মাথা নাড়তে নাড়তে ক্লাস শেষ করতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় ঘটল ঘটনাটা।

রিনরিনে একটা গলা ভেসে এল ক্লাসের একেবারে শেষের কোনা থেকে, ‘পারে স্যার।’ সেই নতুন মেয়েটা! বেচারি জানে না কী ভুল করল!

অজগর স্যার প্রথমে মনে হয় বোঝেননি, তাই আবার সামনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, পারে?’

আবার উত্তর এল, ‘জি।’

সবাই দম বন্ধ করে কোনার মেয়েটার দিকে তাকাল, মেয়েটা এই প্রথম চোখ তুলে সোজা তাকিয়েছে।

 ‘কী বললা তুমি? তুমি ইন্টারনেটের প্রমাণ দেখতে চাও?’

‘না স্যার, ওগুলো হোক্স। মানে ফেইক নিউজ। আর ইন্টারনেটের নিউজ বলে কিছু নেই, কোনো একটা সাইট থেকে এগুলো ছড়ানো হয়।’

 ‘মানে? আচ্ছা, তুমি কি মনে করো আমি মিথ্যা বলতেসি?’ সবাই টের পাচ্ছে অজগর স্যার ভয়ানক রেগে যাচ্ছেন। কোনো একটা ছুতোয় নতুন মেয়েটাকে বকার সুযোগ খুঁজছেন।

 ‘না, তবে ভুল বলছেন।’

 ‘মানে?’

 ‘মানে আপনি বিজ্ঞান কী সেটাই বোঝেন না এবং সেই আপনি বদরাগী। আমার আগের স্কুলে হলে আপনাকে টিসি দেওয়া হতো।’

মানহা আক্ষরিক অর্থে দম বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মেয়েটার সাহস দেখছিল।

 ‘স্যারকে টিসি? হাহাহা!’ অজগর স্যার কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করলেন, ‘আচ্ছা, তার মানে তুমি বলতে চাইতেসো রকেট শূন্যে ভাসে বাতাস ছাড়াই?’

 ‘হ্যাঁ।’

 ‘মানুষ লাফায়ে লাফায়ে এভাবে ব্যাঙের মতো ওড়ে?’ বলে স্যার খুবই হাস্যকরভাবে নভোচারীদের লাফ ব্যঙ্গ করার চেষ্টা করলেন।

 ‘হ্যাঁ।’

 ‘আর কী পারে? বল্।’ অজগর স্যার রাগে হাঁপাচ্ছেন।

 ‘অনেক কিছুই পারে। টেলিকাইনেসিস এখনো আপনারা জানেন না, সেটা জানলে যেকোনো অবস্থাতেই গ্র্যাভিটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যেকোনো মাধ্যমে আপনি ভরশূন্য হয়ে উড়তে পারবেন।’

 ‘ফাজিলের ফাজিল, মিথ্যুকের মিথ্যুক। এইটারে উড়া...।’ বলে অজগর স্যার তার হাতের ডাস্টারটা ছুড়ে মারলেন মেয়েটার দিকে। এবং পুরো ক্লাস স্তম্ভিত হয়ে দেখল, সেটা শূন্যেই ঝুলে ঝুলে আবার স্যারের ডেস্কে গিয়ে বসে পড়ল। স্যার কিছুক্ষণ বোবা হয়ে তাকিয়ে থেকে অবাক হওয়ার বদলে এবার গ্যাঁ গ্যাঁ করতে করতে মেয়েটাকে ধরার জন্য লাফ দিলেন, আর কী আশ্চর্য! স্যার অবিকল নীল আর্মস্ট্রংয়ের মতো, হালকা একটা গ্যাস বেলুনের মতো ছাদের কাছে পৌঁছে আবার একটা পালকের মতো নিচে নেমে ড্রপ খেলেন! এইবার স্যার ভয় পেলেন। পুরো ক্লাস হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে চেঁচাতে লাগল। নাফিসা ফিট হয়ে পড়ে গেল, জিশান কী করবে না বুঝে তালি দেওয়া শুরু করল। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা অজগর স্যারকে নতুন মেয়েটা বলল, ‘দেখেছেন? সবই সম্ভব, যদি আপনি বিজ্ঞান মানেন। বিজ্ঞান আসলে আনন্দের। আপনি যেটা জানেন না, খালি সেটাকেই ভয় লাগে। জেনে নিলেই দেখবেন সব কত সহজ।’

স্যারের এসব শোনার মতো অবস্থা নেই। তিনি অচেতনের মতো কার কাছে যেন চোখ বুজে মাফ চাইছেন। আর ওদিকে হইচই শুনে হেড স্যার বিরাজ ভূষণ নিজে চলে এসেছেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে মানহারা কেউই কিছু বলল না। নাফিসা উঠে বসে হেড স্যারকে দেখে ভয়ে আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকল। মানহা কিছু বলতে গিয়ে টের পেল, এই কথা হেড স্যার বিশ্বাস করবেন না। তাই সে বলল, ‘স্যার, আজগর স্যার পড়াতে পড়াতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।’

দপ্তরিকে ডেকে এনে স্যারকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়া হলো। ক্লাসের সবাই ভয়ের চোখে নতুন মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে। সে একেবারে শান্ত হয়ে মুখ নিচু করে বসে আছে। মানহা সাহস করে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই তোমার নাম কী’?

মেয়েটা মুখ তুলে তাকিয়ে মানহাকে দেখল, তারপর হালকা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘চন্দ্রা।’

সেই থেকে মেয়েটার সঙ্গে সবার খুব খাতির হয়ে গেল। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল, সেটা ক্লাসের কেউ কাউকে বলেনি। অজগর স্যারের কথা কারও বিশ্বাস না হওয়ায় তাঁকে নাকি স্কুল থেকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। মানহাদের নতুন বিজ্ঞান শিক্ষক একজন ম্যাডাম। তিনি খুবই সুন্দর করে গল্প বলে বলে ওদের বিজ্ঞান পড়ান। মানহার কাছে বিজ্ঞান এখন বেশ ভালো লাগে।