বছর গোনার শুরু

মনে করো, তুমি একজন যাযাবর। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মরুভূমির পথে চলেছ। তোমার হাতে কোনো ক্যালেন্ডার নেই। দিন-তারিখের হিসাব রাখবে তুমি কীভাবে? ভাবছ, সূর্য উঠলেই তো নতুন দিনের শুরু হবে। এভাবে ৩০ দিন গেলে বুঝতে পারবে এক মাস গেল। কিন্তু সূর্যের দিকে তাকিয়ে হিসাব রাখা সহজ নয়। কারণ প্রতিদিন একইভাবে সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। এর চেয়ে সহজ বুদ্ধি বরং চাঁদের দিকে নজর রাখা। কারণ চাঁদ একটু একটু করে বাড়তে থাকে। আবার একটু একটু করে কমতে থাকে। চাঁদের বাড়াকে বলা হয় শুক্লপক্ষ। আর চাঁদের ক্ষয়ে যাওয়াকে বলে কৃষ্ণপক্ষ।

আগে যাযাবরেরা এভাবেই চাঁদের কলা বা তিথি দেখে দিন-মাসের হিসাব রাখত। তবে চাঁদের হিসাবে বছর হয় ৩৫৪ দিন ৯ ঘণ্টায়। আর তোমরা নিশ্চয় জানো, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। চাঁদের হিসাবে বছর ধরলে কিছু ঝামেলাও আছে। যেমন কোনো ফসল বোনার জন্য উপযোগী সময়ের কথা আমরা ভাবি। সূর্য সারা বছর ধরে সব জায়গায় একভাবে তাপ দেয় না। আর পৃথিবীও কিন্তু নিজ অক্ষের ওপর একটু কাত হয়ে ঘোরে। ফলে একই জায়গায় বছরের কোনো সময়ে শীত তো অন্য সময়ে গরম বেশি হয়। চাঁদের হিসাবে বছর ধরলে ঋতুর হিসাব এলোমেলো হয়ে যাবে। কারণ সৌরবর্ষের চেয়ে চান্দ্রবর্ষ ১১ দিন কম।

খ্রিষ্টীয় সাল গণনা করা হয় সূর্যের হিসাবে। আবার হিজরি সাল গণনা করা হয় চাঁদের হিসাবে। প্রাচীন মিসরে, ব্যাবিলনে, চীনে এই চান্দ্র মাসের হিসাবে বছর গণনা করা হতো। মুঘল সম্রাট আকবরের সময়েও রাজকাজে হিজরি সাল চালু ছিল। ফলে কৃষি ফলনের সঙ্গে তা মিলত না। আকবর তাই সূর্যের বছরের সঙ্গে চাঁদের বছরের সমন্বয়ের কথা ভাবলেন। দায়িত্ব দিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে। অবশ্য অনেকে বলে থাকেন, বাংলা সাল চালু হয়েছে রাজা শশাঙ্কের সময় (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে।

বাংলা ১২টি মাসের নাম নেওয়া হলো কোত্থেকে? এগুলো নেওয়া হয়েছে একেকটি নক্ষত্রের নাম থেকে। যেমন বৈশাখ মাসের নাম এসেছে বিশাখা নক্ষত্র থেকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের নাম এসেছে জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের নাম এসেছে উত্তর আষাঢ়া ও শ্রবণা নক্ষত্র থেকে। এ রকম ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ মাসের নাম এসেছে পূর্ব ভাদ্রপদ, অশ্বিনী, কৃত্তিকা আর মৃগশিরা নক্ষত্র থেকে। পুষ্যা, মঘা, উত্তর ফাল্গুনী আর চিত্রা নক্ষত্র থেকে এসেছে শেষের চারটি মাসের নাম। এ রকম মোট ২৭টি নক্ষত্র আছে।

এগুলোর পেছনেও রয়েছে গল্প। পুরাণে আছে, রাজা দক্ষের ২৭ কন্যাকে বিয়ে করেছিল চাঁদ। এই ২৭ কন্যাই হলো আকাশের ২৭টি নক্ষত্র। কিন্তু চাঁদ বেশি ভালোবাসত রোহিনি নক্ষত্রকে। তাই দক্ষের অন্য মেয়েরা বাবার কাছে এসে চোখের জল ফেলতে লাগল। চাঁদ তবু আগের মতোই রইল। তখন দক্ষ রেগে গেলেন। চাঁদকে অভিশাপ দিলেন—সে দিনে দিনে ক্ষয়ে যাবে। সত্যি সত্যিই ক্ষয়ে যেতে শুরু করল চাঁদ। তখন সব দেবতা দেখলেন, এ তো আরেক বিপদ! তাঁরা রাজা দক্ষের কাছে গিয়ে অভিশাপ তুলে নিতে বললেন। রাজা দক্ষ তখন বললেন, আচ্ছা, চাঁদ পুরোপুরি ক্ষয়ে যাবে ঠিকই; আবার নতুন করে বাড়তে থাকবে। এভাবে প্রতি মাসে অমাবস্যা আর পূর্ণিমা হবে। আর পূর্ণিমা-অমাবস্যার মধ্যে এক মাসে ২৭ নক্ষত্রের সঙ্গেই দেখা হবে চাঁদের।

তোমাদের আরেকটা ব্যাপার বলে রাখি। সৌরমণ্ডলে এবং এর বাইরে কিন্তু নক্ষত্রের শেষ নেই। তবে বাংলা পঞ্জিকায় ২৭টি নক্ষত্রকে বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়। সাতাশ কেন? কারণ মোটামুটি ২৭ দিনে চাঁদের একটি চক্র শেষ হয়। তোমরা যারা গণিত আর ভূগোল পছন্দ করো, হিসাব করে দেখে নিতে পারো। পৃথিবী তো গোল। এর চারপাশে সব মিলিয়ে আছে ৩৬০ ডিগ্রি। এখন যদি একে ২৭ দিয়ে ভাগ করো, তবে পাবে ১৩ ডিগ্রির কিছু বেশি। তাহলে একেকটি নক্ষত্র ১৩ ডিগ্রির কিছু বেশি জায়গা নিয়ে থাকে।

প্রতিটি নক্ষেত্রের আবার প্রতীক রয়েছে। যেমন বিশাখা নক্ষত্রের প্রতীক কুমোরের চাকা। জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের প্রতীক ছাতা। উত্তর আষাঢ়া ও শ্রবণা নক্ষত্রের প্রতীক তক্তা ও তির। এ রকম পূর্ব ভাদ্রপদ, অশ্বিনী, কৃত্তিকা আর মৃগশিরা নক্ষত্রের প্রতীক তরবারি, ঘোড়া, ছুরি ও হরিণ। পুষ্যা, মঘা, উত্তর ফাল্গুনী আর চিত্রা নক্ষত্রের প্রতীক যথাক্রমে পদ্ম, পালকি, চৌকি ও মুক্তা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই সব নক্ষত্রের সঙ্গে জন্মতিথি মিলিয়ে তোমার রাশি বের করে ফেলতে পারেন। তারপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব হিসাব করে তোমার চরিত্র আর আচার-আচরণ সম্পর্কেও ব্যাখ্যা দিয়ে দিতে পারেন!