নিহত হওয়ার স্বাদ

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

‘আমি তিনবার নিহত হয়েছি! প্রতিবারই আমাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে!’

জ্ঞান ফেরার পরই শমসের নামের লোকটি এ কথা বলছিল, কিন্তু আমরা কেউই তার কথা বিশ্বাস করিনি। করার কারণও নেই। তিনবার তো দূরের কথা, চাইলেও একবারের বেশি মরতে পারে না কেউ।

ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় টহল পুলিশ তাকে খুঁজে পায় গত রাতে। আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ধরেই নিয়েছিলাম, লোকটা মৃত। তারপরও ডাক্তারি পরীক্ষা না করে কাউকে মৃত ঘোষণা করা যায় না। আর সেটা করতে গিয়েই দেখি লাশের হৃৎপিণ্ড তখনো সচল! সবাইকে ভিরমি খাইয়ে দিয়ে অচেতন লোকটা আজ সকালে জেগে ওঠার পরই বলে যাচ্ছে তাকে তিনবার হত্যা করার এই অদ্ভুত গল্প!

‘প্রথমে আমাকে হত্যা করেছে আহাম্মেদুল্লাহ!’ পুলিশ আসার পর লোকটি আবারও বলতে লাগল, ‘শ্বাসরোধ করে, তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে সে।’

স্থানীয় থানা থেকে বাহাদুর ব্যাপারী নামের এক ইন্সপেক্টর এসেছে, মুখভর্তি পান চিবোচ্ছে সে। মাঝবয়সী এই ভদ্রলোককে দেখে মোটেও আশ্বস্ত হতে পারলাম না। এমন রহস্যের সুরাহা করা তার পক্ষে অসম্ভব।

 ‘এরপর আপনি আবার কখন জীবন ফিরে পেলেন?’ আমিই প্রশ্নটা করলাম। যদিও ভেবেছিলাম পুলিশের লোকটাই এসব জানতে চাইবে।

 ‘মরে যাওয়ার কতক্ষণ পর জানি না...’ আহত শমসের বলল, ‘...সম্ভবত এক-দুদিন পর আমি আবার প্রাণ ফিরে পাই!’

ইন্সপেক্টর তখনো নিশ্চুপ। পান চিবোতে চিবোতে শুনেই যাচ্ছে গল্প, কিছুই জিজ্ঞেস করছে না।

‘আমার লাশটা আহাম্মেদুল্লাহ ফেলে দিয়েছিল ঝোপের মধ্যে। সে ভাবেনি আমি আবার প্রাণ ফিরে পাব।’

‘আপনে কেমনে বুঝলেন এতক্ষণ মইরা ছিলেন?’ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বাহাদুর প্রথম প্রশ্নটা করল এবার, ‘এমনও তো হইতে পারে, আপনে আসলে মরেন নাই...জ্ঞান হারাইছিলেন?’

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইল রোগী শমসের, ‘যদি তা–ই হয় তবে দ্বিতীয় মৃত্যুটাকে কী বলবেন?’

আমি আর ইন্সপেক্টর উদ্‌গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দ্বিতীয় মৃত্যুর উপাখ্যান শোনার জন্য।

‘জীবন ফিরে পেয়ে আমি খুবই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠি, আহাম্মেদুল্লাহকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু সে ততক্ষণে পালিয়ে গেছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে আমাকে হত্যা করার সন্দেহে।’

‘কুন থানার পুলিশ?’

‘কেরানীগঞ্জ থানার।’

মাথা নেড়ে সায় দিল বাহাদুর। মনে হলো, এটা সে খতিয়ে দেখবে।

‘আমি আহাম্মেদুল্লাহকে পেলাম না, পেলাম তার ছোট ভাই সলিমুল্লাহকে। আমাকে দেখেই ভয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল সে।’

‘ওয় কেন ডরাইলো?’

‘আমাকে হত্যা করার সময় বড় ভাইয়ের সাথেই ছিল ও।’

বাহাদুরের চোখ এবার কপালে উঠে গেল। আপনি যদি কাউকে চোখের সামনে হত্যা করতে দেখেন আর এক-দুদিন পর দেখেন সেই লোক আপনার সামনে এসে হাজির, তখন ভয় পাওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?

‘আমিও তার পিছু পিছু দৌড়ালাম...কেন এটা করলাম, জানি না। সম্ভবত আমার মাথায় খুন চেপে গেছিল। প্রতিশোধের আগুনে পুড়তেছিলাম।’

‘তারপর?’ লোকটা থামতেই জানতে চাইলাম।

‘সলিমুল্লাহকে ধাওয়া করে জীবনের দ্বিতীয় ভুলটা করলাম আমি। নির্জন এক জায়গায় এসে আমাকে কবজা করে ফেলল সে, তার লোকজন দিয়ে। আমি বুঝতে পারিনি, ওই নির্জন জায়গায় ছিল তার আস্তানা।’

‘আপনেরে ধইরা ফালাইল?’ নিশ্চিত হতে চাইল বাহাদুর ব্যাপারী।

‘হ্যাঁ, সলিমুল্লাহ তার বড় ভাইয়ের অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করল তখন। আমাকে পিস্তলের মুখে আটকে, হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিল। আর আমি তলিয়ে গেলাম ধলেশ্বরীর বুকে।’

‘সেইখান থেইকা কেমনে ফিরা আইলেন?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল বাহাদুর, ‘কবে আইলেন?’

 ‘কত দিন পর জানি না...সম্ভবত এক–দুদিনের বেশি হবে না। জ্ঞান ফেরার পর দেখি, নদীর পাড়ে পড়ে আছি।’

বাহাদুরের মতো আমিও অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছি এই অসম্ভব কাহিনি।

‘দ্বিতীয়বার জীবন ফিরে পেয়ে আমি আর বোকামি করলাম না। প্রতিশোধ নেওয়ার আশা বাদ দিয়ে নিজের জীবন নিয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, মুক্তারের সাথে দেখা হয়ে গেল।’

‘মুক্তার? সে আবার কে?’

বাহাদুরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শমসের, ‘আহাম্মেদুল্লাহর পোষা কুকুর...ডান হাতও বলতে পারেন।’

‘ওয় কীভাবে জানল আপনে বাঁইচ্যা আছেন?’

‘ও জানত না...আমার সাথে দেখা হয়ে গেছিল কাকতালীয়ভাবে।’

‘কোনখানে?’

‘বাসে করে বিক্রমপুর যাচ্ছিলাম, দেশের বাড়িতে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি একই বাসে যাচ্ছে মুক্তারও। আমাকে দেখার পর ভড়কে গিয়েছিল সে। সে জানত, আহাম্মেদুল্লাহ আমাকে হত্যা করেছে।’ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে খানিক ঢোঁক গিলে নিল রোগী, ‘বুঝতে পারছিলাম, আমাকে ও ভূত ভাবছে। ধরে নিয়েছে, আমি ওর পিছু নিয়েছি, আহাম্মেদুল্লাহকে না পেয়ে ওকে ধরার চেষ্টা করছি।’

‘তারপর?’ রোগী একটু থামতেই বাহাদুর শব্দ করল আস্তে করে।

‘প্রথম যে স্টপেজে বাসটা থামল, সেখানে নেমেই কেটে পড়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তখন মধ্যরাত...মাঝরাতে মহাসড়কে হাঁটা ছাড়া আর কোনোভাবে পালানো সম্ভব ছিল না। ভেবেছিলাম মুক্তারকে ধোঁকা দিতে পেরেছি, কিন্তু ভুলটা ভাঙে আধঘণ্টা পর। সড়কের নির্জন এক জায়গায় আসতেই দেখি পিস্তল হাতে সে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে!’

উত্তেজনার চোটে জোরে জোরে পান চিবোতে লাগল বাহাদুর। টের পেলাম, আমার নিশ্বাসও দ্রুতলয়ে উঠছে–নামছে।

‘মুক্তারকে দেখে পা দুটো স্থির হয়ে গেছিল আমার। কেন জানি আর পালাতে পারিনি। হয়তো দু–দুবার মৃত্যুবরণ করার পর আমি ভাবতে শুরু করেছিলামÑমুক্তার চাইলেও আমাকে মারতে পারবে না।’ একটু থেমে আবার বলে উঠল রোগী, ‘মুক্তার খুব বেশি সময় নেয়নি, সোজা আমার মাথায় পিস্তল তাক করে কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়েছিল। অনুনয়–বিনয় করে তার মন গলানোর চেষ্টা আমি করেছিলাম, নিজের ছোট্ট সন্তানের কথাও বললাম করুণা পাওয়ার জন্য, কিন্তু ওর শীতল চোখ দেখে বুঝে গেছিলাম, আমাকে মরতে হবে...আবারও!’

‘এরপরই পুলিশ আপনেরে রাস্তায় খুঁইজ্যা পায়?’

‘আমি না, আমার লাশকে!’

এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। লোকটার গল্প বিশ্বাস করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না, কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, তার কথায় সত্যতা আছে! কারণটা আমার নিজেরও অজানা।

‘এরপর তো সবই জানেন...তৃতীয়বারের মতো জীবন ফিরে পেলাম।’

এতক্ষণে আমার দিকে তাকাল বাহাদুর ব্যাপারী। বুঝলাম তার ইঙ্গিতটা। মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এই লোক অলৌকিকভাবেই প্রাণে বেঁচে গেছে। তার মাথার বাঁ পাশে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছিল, গুলিটা খুলি দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে, স্থায়ীভাবে মস্তিষ্কে ক্ষতিও হয়েছে নিশ্চয়। পরবর্তী সময়ে সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। তবে প্রাণঘাতী বুলেট তার প্রাণ কেড়ে নিতে পারেনি, এটাই হলো সবচেয়ে ভড়কে যাওয়ার মতো ব্যাপার। অন্তত লোকটার দাবির পক্ষে এই শক্তিশালী প্রমাণটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাহাদুর ব্যাপারীকে দেখে মনে হলো কোনো কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। অবশ্য আমারও একই অবস্থা। দেখতে স্মার্ট না হলে কোনো পুলিশ অফিসার কিংবা গোয়েন্দার ওপরে কি আস্থা তৈরি হয়? বাহাদুরের ভেবলাকান্ত চেহারার মধ্যে আস্থার আ-টাও খুঁজে পেলাম না। পান খেতে খেতে ভদ্রলোক চলে গেল রোগীকে রেখেই।

দ্বিতীয় দিনেও রোগীর মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা দেখলাম না,Ñএ রকম ঘটনায় যা খুবই বিরল। তার সঙ্গে টুকটাক কথা হলেও ওই উদ্ভট গল্পটা নিয়ে কোনো কথাই বললাম না। এদিন আবারও হাসপাতালে এল বাহাদুর ব্যাপারী, শমসের নামের রোগীর কাছে বসে একই গল্প শুনে গেল সে। তার বলা গল্পে কোনো হেরফের হলো না। একেবারে প্রথমবার যা বলেছিল, সেটাই হুবহু বলল আবার। ডাক্তার হিসেবে আমি বিরক্ত হলাম। ইন্সপেক্টরকে বললাম, এই রোগী বিস্ময়করভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার মস্তিষ্কে ভয়াবহ রকমের ক্ষতি হয়েছে, তাকে এ মুহূর্তে এক কথা বারবার জিজ্ঞেস করে মানসিক চাপ দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমার কথায় হেসে ফেলল বাহাদুর। রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার নাকি মনেই হচ্ছে না লোকটার মাথায় কোনো সমস্যা আছে। যা হোক, আমার সতর্কতার পরও রোগীকে ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন করল সে। শমসের খুব বেশি কিছু জানাতে পারল না অবশ্য। শুধু জানাল, তার মা-বাবা অনেক আগেই মারা গেছে। ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তান কিচ্ছু নেই। তার আদি বাড়ি বিক্রমপুরের গাঁওদিয়া গ্রামে।

কিছুক্ষণ পর আমার কাছে এল বাহাদুর। কান চুলকাতে চুলকাতে এবং পান চিবুতে চিবুতে বলল, শমসের যে তিনজনের কথা বলছে, তারা সবাই–ই গা ঢাকা দিয়েছে। কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

‘তাহলে এই লোক যা বলেছে, সবটাই সত্যি?’

আমার বিস্মিত চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে একবার কাঁধ তুলল বাহাদুর, ‘বুঝবার পারতাছি না...হের অনেক কথারই মিল পাইতাছি, তয় খটকাও আছে কিছু।’

‘কী রকম?’

প্রশ্নের উত্তরে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকল বাহাদুর। একপর্যায়ে ছোট্ট করে বলল, ‘তদন্ত চলতাছে...শ্যাষ হউক, সব জানামুনে।’

এরপর উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে চলে গেল ইন্সপেক্টর। আর মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সারা দিন নিজের বেডে বসেই কাটিয়ে দিল শমসের। তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই দেখলাম না।

তৃতীয় দিন সকালেই শোরগোল পড়ে গেল হাসপাতালে। বাহাদুর ব্যাপারী থানা থেকে আরও কিছু পুলিশ নিয়ে হাজির। মাথার টুপিটা খুলে কিছুক্ষণ আফসোসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শমসেরের দিকে। খানিক বাদে মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও সে করল। রোগী তখনো কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে কোনো প্রশ্নও করল না। ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল কেবল।

‘তারে পুলিশের জিম্মায় রাখা দরকার।’ বাহাদুর বলল আমাকে।

‘কিন্তু কেন?’

‘পুলিশ আইজকা ভোরে দুইটা লাশ খুঁইজ্যা পাইছে’, দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইন্সপেক্টর, ‘আহাম্মেদুল্লাহরটা ধলেশ্বরীর পাড়ে এক ঝোপে...সলিমুল্লাহরটা ধলেশ্বরী নদী থেইকা।’

মূর্তির মতো জমে গেলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য।

বাহাদুর আরও জানাল, মুক্তার নামের যার কথা বলেছে শমসের, সে মারা গেছে দুই মাস আগে। লোকটা নাকি আত্মহত্যা করেছিল। আর আহাম্মেদুল্লাহর সঙ্গে শমসের নামের একজনকে চলতে–ফিরতে দেখেছে কেরানীগঞ্জের অনেক মানুষজন, তবে তাকে কেউ ভালো করে চেনে না। সম্ভবত সে এখানে বেশি দিন আগে পা রাখেনি।

ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে আরও জানা গেল, সলিমুল্লাহ নামের দ্বিতীয় খুনির গত মাসেই এক ছেলেসন্তান হয়েছে। তার পরিবার জানিয়েছে, সেই সন্তানের মুখটাও সে দেখেনি। লাপাত্তা হয়ে আছে কয়েক দিন ধরে। কিন্তু শমসের তাকে জানিয়েছিল, সলিমুল্লাহ তাকে খুন করার সময় নিজের সন্তানের মুখ দেখার জন্য আকুতি জানিয়েছিল সে। অথচ পরে পরিবারের কথা জানতে চাইলে সে জানায়, তার বাবা-মা মারা গেছে, স্ত্রী-সন্তানও নেই। এই একটি খটকা থেকেই বাহাদুর পুরো গল্পটা সাজিয়ে নিতে পেরেছে।Ñঅদ্ভুত এই রোগীর বলা গল্পগুলো ঠিকই আছে, শুধু তিনজন খুনির জায়গায় তাকে বসিয়ে দিলেই হলো!

‘এই লোক আত্মহত্যা করেছিল?’

আমার প্রশ্নে সায় দিল বাহাদুর, ‘হ...মুক্তারের মতোনই।’

‘তাহলে পুলিশ পিস্তলটা খুঁজে পেল না কেন?’

কাঁধ তুলল বাহাদুর, ‘হইবার পারে, যে প্রথম লাশটা দেখছিল হে সরায়া ফালাইছে?’

সায় দিলাম আমি। ইন্সপেক্টর আরও জানাল, আহাম্মেদুল্লাহ আর সলিমুল্লাহ নামের দুই ভাই এখানকার ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত, মুক্তার ছিল তাদের পোষা খুনি। অনেক খুনখারাবি করিয়েছে তাকে দিয়ে, পরে ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে যায়, নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে সে। মুক্তারের জায়গায় আহাম্মেদুল্লাহ এই শমসেরকে নিয়ে আসে। কোত্থেকে কীভাবে একে জোগাড় করেছিল সেটা অবশ্য বের করা যায়নি এখনো।

‘কিন্তু এই লোক তার মনিব আর তার ভাইকে হত্যা করল কেন?’

আমার প্রশ্নে গাল চুলকাল বাহাদুর, ‘যতটুকুন বুঝবার পারতাছি, অ্যাগেইনস্ট পার্টির কাছ থিকা ট্যাকা খাইয়া এই কাম করছে। থানার এক ইনফর্মার আমারে জানাইছে, পরশপাথর গ্রুপ নামের এক বিরাট বড় রিয়েল এস্টেটের লগে তাগোর সমস্যা চলতাছিল কিছুদিন ধইরা।’

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আমি গল্পের বাকি পাজলগুলো মেলাতে শুরু করলাম: বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের মনিব আর তার ভাইকে হত্যা করার পর যেকোনো কারণেই হোক তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে শমসের। সেই অনুশোচনা তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। মুক্তারের মতো সে-ও অনুশোচনা থেকে মুক্তি পায় আত্মহত্যা করার মধ্য দিয়ে; কিন্তু বুলেট তার মস্তিষ্ক ভেদ করলেও ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যায় সে। তবে বুলেটের কারণে তার মস্তিষ্কে একধরনের বিপর্যয় ঘটে—যে তীব্র অনুশোচনার জন্ম হয়েছিল তার মধ্যে, সেটা এমন কিছুতে রূপান্তরিত হয় যে খুন করা মানুষগুলোকে নিজের জায়গায় ভাবতে শুরু করে লোকটি—বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাকেই তিনবার হত্যা করা হয়েছে।

আর শমসেরের তৃতীয় হত্যাকাণ্ডটি ছিল আসলে নিজেকে হত্যা করা!