তিমিরের প্রতিজ্ঞা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

নাড়ু তিমিরের ভীষণ প্রিয়। আর প্রিয় গুড়ে পাক দেওয়া খই। খইয়ের জন্য অবশ্য তিমিরের অতটা ‘খাই খাই’ নেই। কিন্তু নাড়ু পেলে তিমিরের আর ‘না’ নেই। মায়ের হাতের রাজভোগের মতো একেকটা চিনির নাড়ু; যেমন তার ঘ্রাণ, তেমন স্বাদ! মুখে দিলেই দারুচিনির মিষ্টি ঝাঁজ আর তেজপাতার সুবাস কোত্থেকে যে আসে, তিমিরের কাছে আজও তা রহস্য।
তিমিরদের বাড়িতে প্রতিবছর দুর্গাপূজা হয়। এবারও হবে। বাড়ির সবাই পূজার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। মা মহাব্যস্ত পূজার ঘরে। সেখানেই আলাদা মাটির চুলায় পূজার সবকিছু তৈরি হচ্ছে—লুচি, মিষ্টান্ন, খিচুড়ি, খই, দুই রকমের মোয়া, তিন রকমের নাড়ু আরও কত কী!
পূজায় বাদ্য যেমন, খাদ্যও তেমন। উৎসবজুড়ে এই দুইয়ের প্রতিযোগিতা। মা, ঠাকুমার ব্যস্ততা খাদ্য নিয়ে। বড়দা দেখছেন বাদ্য। তিমিরের ব্যস্ততাও কম নয়। সে ব্যতিব্যস্ত নাড়ুর খোঁজে। যদিও পূজামণ্ডপ থেকে ভেতরবাড়ি ছোটাছুটি করতেই তিমিরের দিন শেষ। এর সঙ্গে বড়দের যখন-তখন হুকুম তো আছেই।
‘এই বেলপাতা আনো রে।’
‘ধুত্তোরি! ধূপকাঠি বাদ পড়েছে। এনে দে।’
‘ঠাকুর মশায় আবার কই গেল? ডেকে নিয়ে আয়।’
তিমিরের এত ছোটাছুটি ভালো লাগে না। সবকিছুতেই শুধু তিমির আর তিমির।
তিমির বিড়াল পায়ে ঘরে এসে ঢোকে। মা নাড়ু বানাচ্ছেন। নাড়ির টানে নয়, নাড়ুর টানেই যে তিমিরের হঠাৎ এই আগমন মা ঠিকই বুঝতে পারেন। দুই হাতের তালুতে নাড়ু ঘোরাতে ঘোরাতে মা ব্যস্ত কণ্ঠে বলেন, ‘এখানে ঘুরঘুর করে লাভ নেই। পূজা হোক তারপর।’
শুনে তিমিরের মাথাটাই যেন ঘুরে ওঠে। বলে কী! পূজার এখনো অনেক দেরি। তিমিরের মনোভাব বুঝতে পেরে ঠাকুমা মুচকি হেসে বলেন, ‘বুঝলে দাদু, আগে দেবীর পূজা, তারপর পেটপূজা।’
‘পেটপূজা’ শব্দটা তিমিরের ভালো লাগে।
‘পেটপূজা। বাহ্‌!’ তিমির নিজের মনেই কথাটি আওড়ায়।
ব্যর্থ মনোরথে তিমির পূজামণ্ডপে এসে দাঁড়ায়। ঠাকুর মশায় পূজায় বসবেন। পদ্মফুল, চন্দন, বেল পাতা, তুলসী গুছিয়ে রাখছেন। পূজার ভোগ এখনো ভেতরবাড়ি থেকে আসেনি। অথচ তিথির সময় চলে যায়। ঠাকুর মশায় তিমিরকে দেখে তাড়া দেন। তাড়া খেয়ে একছুটে মাকে গিয়ে সে কথা বলতেই মা দ্বিগুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মা, ঠাকুমা দুজনই নকশা করা কাঁসার থালায় সবকিছু তড়িঘড়ি গোছাতে শুরু করেন। সাহায্য করার জন্য তিমিরও হাত বাড়ায়। ওমা! থালার দিকে হাত বাড়াতেই মা গরম তেলের ওপর ছিটকে পড়া জলের মতো ছ্যাঁৎ করে ওঠেন।

‘আহা! ছুঁস না।’

তিমির লাফিয়ে উঠে সরে দাঁড়ায়। আরেকটু হলেই চিতপটাং হয়েছিল আর কি! পূজার জিনিস ছুঁয়ে দিতে নেই—ব্যাপারটা মনেই ছিল না।

ঠাকুমাও ধমকে ওঠেন, ‘একটুও সুস্থির থাকতে পারিস না? এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। আমরা এগুলো মণ্ডপে দিয়ে আসছি। দেখিস, বিড়াল যেন কোনো কিছুতে মুখ না দেয়।’ ঠাকুমা মাকে নিয়ে মণ্ডপের দিকে পা বাড়ান।

সাহায্য করতে গিয়ে উল্টো ধমক খেতে হবে, তিমির এটা ভাবেনি। মনটাই দমে যায়। কিন্তু কতক্ষণ? পরক্ষণে থালাভর্তি নাড়ুর দিকে চোখ পড়তেই আনন্দে তার চোখ দুটো ওই নাড়ুর মতোই গোল গোল হয়ে যায়। আশপাশটা একবার দেখে তিমির এক নিশ্বাসে কয়েকটা নাড়ু টপাটপ মুখের ভেতর চালান করে দেয়।

মা ফিরে এসে অর্ধেক থালা নাড়ু দেখে প্রথমে একটু অবাক হন। মায়ের অবাক চোখে সন্দেহ ফুটে উঠতে একেবারেই সময় লাগে না। ছুটে পালানোর আগেই মা খপ করে তিমিরের হাত ধরে ফেলেন।

‘তুই এখান থেকে নাড়ু খেয়েছিস?’

দেবী দুর্গাই এখন তিমিরের ভরসা। কপালে আজ কী আছে, কে জানে! মনে মনে দেবীর নাম জপতে থাকে তিমির। কিন্তু ভোগের প্রসাদ পূজার আগে খেলে দেবী কি আর ছেড়ে কথা বলবেন? মা হাত ছেড়ে তিমিরের চুলের মুঠি ধরেন।

‘চুপ করে আছিস কেন? বল!’

তিমির আর কী বলবে? শরীরের সমস্ত বল তো ভয়েই শেষ হয়ে আসছে। এমন সময় ঠাকুমাকে আসতে দেখে তিমির কিছুটা সাহস ফিরে পায়। ঠাকুমা ঘরে ঢুকে সব শুনে প্রথমেই মারমুখী মায়ের হাত থেকে তিমিরকে উদ্ধার করেন। তার একটাই কথা, পূজার এই আনন্দের সময় ছোটদের গায়ে কিছুতেই হাত তোলা যাবে না। তবে অন্যায় যেহেতু করেছে, শাস্তি পেতেই হবে। এই অন্যায়ের শাস্তি হলো, মার কাছে ক্ষমা চাওয়া।

কী আর করা! তিমির গোমড়া মুখে ‘সরি’ বলতেই মা এবং ঠাকুমা দুজনই হেসে ওঠেন।

‘এখানে সরি বললে তো হবে না, দাদুভাই। মণ্ডপে গিয়ে মাকে প্রণাম করে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’ ঠাকুমা তিমিরের এলো চুলে আদর করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘দেবী দুর্গাকে দুর্গতিনাশিনী কেন বলে, জানিস? তিনি সকলের দুর্গতি দূর করেন। যখনই কোনো বিপদে পড়বে, মাকে স্মরণ করবে। তাঁর কৃপাতেই আমাদের সব বিপদ কেটে যায়।’

মণ্ডপে ঢাকের শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। পূজা শুরু হবে। ঠাকুমার কথা শুনে তিমির মণ্ডপের দিকে পা বাড়ায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর কখনো চুরি করে কিছু খাবে না সে।