কবি মেহেরুন্নেসার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা (১৯৪২-১৯৭১)। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা (১৯৪২-১৯৭১)। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসার ৭৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে বক্তারা মেহেরুন্নেসার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানিয়েছেন।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে এ দাবি জানানো হয়েছে। স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবন এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের যৌথ আয়োজনে মেহেরুন্নেসাকে নিয়ে ডকুফিকশন চলচ্চিত্র ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’, একক নাট্য ‘মেহের বলছি’ ও দুর্লভ চিত্র প্রদর্শনী এবং মেহেরুন্নেসার লেখা কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক অধ্যাপক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘মেহেরুন্নেসা আমাদের ইতিহাসের একটি মহান অংশ। স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা বললেই মেহেরুন্নেসার কথা চলে আসে। তিনি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন। মেহেরুন্নেসা আমাদের নতুন প্রজন্মকে একটি সুন্দর দেশ ও জীবন দান করে গেছেন।’

অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সাংস্কৃতিক ভুবনের প্রধান উপদেষ্টা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা ড. মনোরঞ্জন ঘোষাল। তিনি বলেন, ‘মেহেরুন্নেসার মতো বিপ্লবীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। তিনি যেমন আমার প্রেরণা ছিলেন, তেমনি যুগে যুগে নতুন প্রজন্মের কাছেও তিনি প্রেরণা হয়ে থাকবেন।’

অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক সাবেক সাংসদ স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের উপদেষ্টা কবি কাজী রোজী বলেন, ‘মেহেরুন্নেসাকে আবারও সামনে নিয়ে আসতে হবে। দেশে অনেক অনিয়ম হচ্ছে। অথচ মেহেরুন্নেসার মতো করে কেউ প্রতিবাদ করছেন না। এখন তাই নতুন প্রজন্মের মেহেরুন্নেসাদের সামনে এনে আমাদের নতুন করে লড়াইয়ে নামতে হবে। সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’ রাষ্ট্রীয়ভাবে মেহেরুন্নেসার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের দাবি জানান তিনি।

মেহেরুন্নেসার স্মৃতি রক্ষার জন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের প্রতিষ্ঠাতা রিয়াজ মাহমুদ মিঠু বলেন, সরকারি অর্থায়নে মিরপুরে মেহেরুন্নেসা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। সরকারের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে মেহেরুন্নেসার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসার ৭৭ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় বক্তারা। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসার ৭৭ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় বক্তারা। ছবি: সংগৃহীত

সভাপতির বক্তব্যে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘মেহেরুন্নেসা যে সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, সে সময় একজন নারীর জন্য বিপ্লবী হওয়া, বিপ্লবী কবিতা লেখা খুব সহজ ছিল না। বিপ্লবীরা কখনো মরে না, মেহেরুন্নেসাও মরেননি। তিনি চিরভাস্মর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।’

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির বাণিজ্যিক বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম, টেলিভিশনের সহকারী পরিচালক কবি কাজী মোহিনী ইসলাম প্রমুখ। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নুরুল ইসলাম বাবুলের সঞ্চালনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের ফরিদ আহমাদ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বপ্নকলার পরিচালক নোমান বিন সাদেক, মোহাম্মদ সোহেল, তাবাসসুম আম্বিয়া সামিরা, মাসুম বিল্লাহ, মহারাজসহ সিইউবি মিডিয়া ক্লাবের সদস্যরা।

কবি মেহেরুন্নেসা
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা (১৯৪২-১৯৭১)। ১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের খিদিরপুরে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা আবদুর রাজ্জাক, মা নূরুন নেসার চার সন্তানের মধ্যে মেহেরুন্নেসা (রানু) ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁরা ছিলেন চার ভাইবোন।

১৯৪৭ সালে বিভক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তার পুরো পরিবার চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (ঢাকায়)। প্রথমে পুরান ঢাকায় থাকতেন। একপর্যায় মিরপুরে স্থায়ী হন। কবিতা লেখার ঝোঁক ছিল শৈশব থেকেই। ১৯৫৪ সালে খেলাঘরের পাতায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘চাষী’ প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়ে ‘ইত্তেফাক’, দৈনিক ‘পাকিস্তান’, মাসিক ‘মোহাম্মদীসহ’ মূলধারার পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতো। ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উদ্যোগে ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠিত হলে তিনিও মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে এই কমিটির সভা-মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। ৭ মার্চ ১৯৭১, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে তিনি দুই ভাইকে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মিরপুরে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এসব কারণে ২৭ মার্চ তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি আলবদররা অতর্কিতে আক্রমণ করে। তাঁর দুই ভাই রফিক ও টুটুল এবং মাকেসহ তারা মেহেরুন্নেসাকে নারকীয়ভাবে হত্যা করে। প্রেস বিজ্ঞপ্তি।