বিশ্বের শীর্ষ চারে কাওসারের জুমশেপার

রাজধানীর ধানমন্ডিতে জুমশেপারের কার্যালয়ে সারাক্ষণই থাকে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কাওসার আহমেদ (সবার সামনে) সহকর্মীদের সঙ্গেই থাকেন। গতকাল তোলা ছবি l জিয়া ইসলাম
রাজধানীর ধানমন্ডিতে জুমশেপারের কার্যালয়ে সারাক্ষণই থাকে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কাওসার আহমেদ (সবার সামনে) সহকর্মীদের সঙ্গেই থাকেন। গতকাল তোলা ছবি l জিয়া ইসলাম

লিফট থেকে বেরোলেই বড় দেয়ালজুড়ে ইংরেজিতে কোম্পানির নাম লেখা। কাচের দরজার সামনে দাঁড়ালে ভেতর থেকে কেউ একজন দরজাটা খুলে দেবে। ভেতরে ঢুকে আপনার মনে হতে পারে, ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন—এটি কোনো অফিস, নাকি জিম বা খেলার জায়গা!

ভেতরে এগিয়ে গেলে প্রথম যেটা চোখে পড়বে, সেটি হলো ‘টেবিল-ফুটবল’ খেলার আয়োজন। পাশে কাঠের গ্যালারিও আছে। বোঝা যাচ্ছে, খেলার সময় দর্শকেরাও যেন এর অংশ হতে পারে, তার সুব্যবস্থা। তারপর আরেকটু এগোলে টেবিল টেনিস খেলার টেবিল। খেলার আয়োজন ও সরঞ্জাম দেখে মনে হবে কোনো স্পোর্টস ক্লাবের অফিস। তবে এরপরই একদল তরুণকে কম্পিউটারের সামনে বসে বুঁদ হয়ে কাজ করতে দেখলে আপনার ভুল ভাঙবে। যাক, তাহলে এখানে কাজ হয়। কিন্তু সেসব কাজের টেবিল পেছনে রেখে আরও এগোলেই চোখে পড়বে অফিসেই দুপুরের ঘুমের আয়োজন, কফি কর্নার আর আড্ডা দেওয়ার জায়গা। একটা ছোটখাটো লাইব্রেরিও চোখে পড়ে, যেখানে কারিগরি বইয়ের চেয়ে গল্প-উপন্যাসই বেশি। ঠিক এমনই অফিসের বর্ণনা আমরা পড়ি গুগল ও ফেসবুকসহ যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে।

অফিসের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর কক্ষে গেলে দেখা যাবে, সেখানে কেউ নেই। তাঁকে পাওয়া যাবে সাধারণ কর্মীদের কাজের ফ্লোরে। সবার সঙ্গে একই জায়গায় বসে কাজ করছেন তিনি। আপনাকে দেখে উঠে আসবেন বাংলাদেশের অন্যতম জুমলা সিএমএস টেমপ্লেট ক্লাব ‘জুমশেপার’-এর তরুণ প্রধান নির্বাহী কাওসার আহমেদ। এরই মধ্যে আপনার মনে পড়ে যাবে, সিনেমায় কিংবা ইউটিউবে আপনি বিদেশি আইটি কোম্পানির অফিসের এমন ছবিই দেখেছেন। কাওসার আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলবেন তাঁদের অফিসের সম্পূর্ণ সাদা অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা হওয়ার কারণ—এটি মনের মধ্যে একধরনের শুভ্রতা তৈরি করে, আর মনের প্রফুল্লতা না থাকলে কাজ ভালো হয় না।

আপনার হয়তো বিশ্বাসই হতে চাইবে না যে, খেলাধুলা আর গল্প করার এমন পরিবেশের মধ্যেই জুমলাভিত্তিক ওয়েব কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুনিয়াজুড়ে শীর্ষ চারটি কোম্পানির একটি হলো জুমশেপার।

জুমলা হলো ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট বানানোর একটি কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা বিষয়বস্তু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ধরনের বিষয় প্রকাশ করা যায়। বিভিন্ন ধরনের ওয়েবসাইট বানানোর জন্য বিভিন্ন রকমের ডিজাইন ও বিন্যাসের দরকার। কাজেই অনেকে নানান কাজের উপযোগী ডিজাইন ও বিন্যাসের কিছু কাঠামো আগে থেকেই তৈরি করে রাখেন। এগুলোকে বলা হয় টেমপ্লেট। নতুন ওয়েবসাইট বানানোর সময় অনেকেই সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য এই টেমপ্লেট ব্যবহার করেন। বিভিন্ন ‘মার্কেটপ্লেস’ থেকে এই টেমপ্লেট কিনতে পাওয়া যায়।

২০১০ সালে ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা থেকে টেক্সটাইল প্রকৌশলী কাওসার আহমেদ এই জুমলা টেমপ্লেট বানানোর কাজ শুরু করেন। আর অন্য কোনো ক্রয়বিক্রয় ওয়েবসাইট (মার্কেটপ্লেসে) সেটি বিক্রি না করে নিজেই জুমশেপার (www.joomshaper.com) নামে একটা ক্রয়বিক্রয় ওয়েবসাইট তৈরির কাজ শুরু করেন। বর্তমানে বিশ্বে রকেটথিম, উথিম এবং জুমলার্ট মার্কেটপ্লেসের পরই জুমশেপারের অবস্থান।

জুমশেপারে এখন ৮৮টি জুমলা টেমপ্লেট আছে এবং প্রতিমাসে একটি করে নতুন টেমপ্লেট যুক্ত হচ্ছে। ক্রেতারা ইচ্ছা করলে ৫৯ থেকে ২৯৯ ডলারের তিন রকমের সদস্য হয়ে টেমপ্লেট কিনে ডাউনলোড করতে পারেন। এসব টেমপ্লেট এ পর্যন্ত ৪৫ লাখের বেশি ডাউনলোড হয়েছে। কাওসারের কোম্পানির সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশে। ১১-১৩ নভেম্বর কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে অনুষ্ঠিত হবে জুমলা ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স ২০১৬, যার গোল্ড স্পন্সর জুমশেপার। গত বছর থেকে বেঙ্গালুরু, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরের জুমলা কনফারেন্সগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করছে কাওসারের এই প্রতিষ্ঠান। ‘বিশ্ববাসীর জানা দরকার, বাংলাদেশের কোম্পানিও এ ধরনের অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে,’ — ব্যাখ্যা করেন কাওসার।

তবে কাওসারের শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। টেক্সটাইল কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি) পড়ার সময় টিউশনির টাকা জমিয়ে ২০০৬ সালে এলিফ্যান্ট রোড থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে অনেক পুরোনো কম্পিউটার কেনেন কাওসার। তাতেই তাঁর প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি। কলেজের আবাসিক হলে কোনো ইন্টারনেট নেই। কাজেই কাওসারের ভরসা বই আর সাইবার ক্যাফের ইন্টারনেট। তা দিয়েই ধীরে ধীরে দক্ষতা বাড়ানো। শুরুতে ডেস্কটপ প্রোগ্রামিং ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ করে কাওসার আসেন ওয়েবের দুনিয়ায়। আর খুঁজতে থাকেন নতুন কোনো কাজ, যা দীর্ঘদিন ধরে কাজে লাগবে। একসময় বুঝতে পারেন, ওয়েবসাইট না বানিয়ে বরং ওয়েবসাইট বানানোর কলকবজা বানানোই ভালো হবে। তারপরই শুরু জুমশেপারের।

জুমলার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ছে কাওসার ও তাঁর দলের কাজ। গড়ে উঠেছে ওয়ার্ডপ্রেসের থিম বিপণনের জায়গা থিমিয়াম (http://www.themeum.com/)। ২০১৫ সালের জুন মাসে শুরু হয়েছে এইচটিএমএল (এটি হলো ওয়েবসাইট বানানোর আদি কম্পিউটার ভাষা) টেমপ্লেটের জন্য মার্কেটপ্লেস শেপবুটস্ট্র্যাপ (https://shapebootstrap.net/)। এরই মধ্যে এটি দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। এই ক্রয়বিক্রয় ওয়েবসাইটে যে কেউ সদস্য হয়ে তাঁর বানানো টেমপ্লেট বিক্রি করতে পারেন। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ২ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি, যাঁরা এরই মধ্যে তৈরি করেছেন ৩৪৬টি টেমপ্লেট। প্রতিদিনই সেখানে যোগ হচ্ছে এইচটিএমএলের নতুন নতুন টেমপ্লেট।

জুমশেপারের সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কাওসার বলেন, ‘আমি যখন অফিস শুরু করি, তখন বেশির ভাগ কর্মীই সময়মতো আসত না, ঠিকমতো কাজ করত না। পরে আমি নিয়োগের ক্ষেত্রে অমায়িক, ভদ্র এবং ডেডিকেটেড কর্মীদের প্রাধান্য দিতে শুরু করি। এর ফলে আমাদের একটা চমৎকার টিম হয়েছে। আমাদের সাফল্যের পেছনের কারণ আমাদের টিম, সবার একাগ্রতা ও নিষ্ঠা।’

আগামীতে জুপশেপারকে বিশ্বের এক নম্বর জুমলা কোম্পানিতে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেন ৩২ বছরের এই তরুণ উদ্যোক্তা। বাবা মোহাম্মদ আলী আকবর ও মা জাহেদা খাতুনের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে কাওসার দ্বিতীয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে চাকরিজীবী স্ত্রী জিনিয়া আখতার ও কন্যা জারাকে নিয়ে মোহাম্মদপুরে থাকেন কাওসার। ২০১৬ সালে তরুণ উদ্যোক্তাদের সংগঠন ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ তাঁকে ‘নুরুল কাদের সম্মাননা ২০১৫’তে ভূষিত করে।