গৌরবের ৫০ বছর

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো

পাহাড়, ঝরনা, ঘন সবুজ অরণ্য—প্রকৃতির সব সৌন্দর্যই যেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এরপরও যদি কারও অতৃপ্তি থাকে, তার জন্য রয়েছে শাটল ট্রেন। বাংলাদেশে একমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই ট্রেন রয়েছে। ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পাসে যাওয়ার সুযোগ আর কারও নেই।

এখন যাঁরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তাঁরা চাইলে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিয়েও ভীষণভাবে গর্ববোধ করতে পারেন। ইতিহাস ঘেঁটে কারও নাম খুঁজে বের করার দরকার নেই। এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত, জনপ্রশাসন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে রয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের তালিকার কয়েকটি নাম এখন বেশ আলোচিত। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক।

দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সে ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া সাজিদ আলী হাওলাদার এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র।

প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ শুক্রবার থেকে দুই দিনব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ৫০ বছর আগে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীর ফতেপুর ইউনিয়নের ১ হাজার ৭৫৩ একর জায়গা নিয়ে যাত্রা শুরু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। তখন বিভাগ ছিল চারটি—বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি। ২০৪ জন শিক্ষার্থী ও ৭ জন শিক্ষক নিয়ে পথচলা শুরু করা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ হাজার ৮৭৬ এবং
শিক্ষক ৮৯৯ জন। রয়েছে আটটি অনুষদ, ৪৩টি বিভাগ, ৭টি ইনস্টিটিউট ও ৫টি গবেষণাকেন্দ্র।

সামুদ্রিক বিজ্ঞান ও বনবিদ্যা বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথমবারের মতো ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ এবং ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস চালু করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর শামসুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাবা ও আমি একসঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে যানবাহন চলাচলের রাস্তাও ছিল না। মনে আছে, ধূলিধূসর কাঁচা রাস্তা, বিল—এসব পার হয়ে আমরা অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছাই। টিলাময় সে স্থানে সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম প্রত্যক্ষ করার বিরল সুযোগ হয়েছিল।’

প্রয়াত সাহিত্যিক আবুল ফজল, প্রয়াত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম, প্রয়াত কবি ও নাট্যকার আলাউদ্দিন আল আজাদ, প্রয়াত শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান, প্রয়াত কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল, প্রয়াত শিল্পী রশিদ হোসেন চৌধুরী (রশিদ চৌধুরী), প্রয়াত নাট্যকার জিয়া হায়দার এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশির। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে একুশে পদক পেয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জানান, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বর্তমানে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ১১ জন ও অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত আছেন ৩০ জন।

স্বাধীনতাসংগ্রামেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুর দিকে তৎকালীন উপাচার্য এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ১৫ জন সদস্য।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী রিদওয়ানুল ওদুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ বছর পার করছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার, সচিবসহ বিভিন্ন পদে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষক নোবেল পেয়েছেন। আমরাও এ গৌরবের অংশীদার।’

সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের প্রথম দিন আজ শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শোভাযাত্রা বের হবে। সন্ধ্যায় নগরের জিইসি মোড়ের জিইসি কনভেনশন সেন্টারে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে ‘ওয়েলকাম নাইট’। এতে গান পরিবেশন করবেন শিল্পী রুনা লায়লা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাল শনিবার সকাল ১০টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে হবে এ অনুষ্ঠান। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সম্মাননা দেওয়া হবে অনুষ্ঠানে। আলোচনা সভা শেষে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন পরিষদের সমন্বয়ক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এ উৎসবে প্রাক্তন ও বর্তমান মিলিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকবেন।