সরকার আসে সংখ্যা বাড়ে

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ ই–আর্কাইভ ট্রাস্ট
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ ই–আর্কাইভ ট্রাস্ট

নতুন সরকার এলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন হয়, বেড়ে যায় সংখ্যা। গত ৪৫ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১০ বার পাল্টেছে। আসন্ন জানুয়ারি থেকে নতুন করে আরও মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করতে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখের বেশি হলেও অনলাইনে ও সরাসরি আরও দেড় লাখ আবেদন জমা পড়েছে। সাংসদের নেতৃত্বে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে যে কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করবে, ইতিমধ্যে তাদের সম্মানী ও খরচ বাবদ প্রায় সোয়া চার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, এসব তালিকা যাচাই-বাছাই করে পাঁচ হাজারের বেশি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যাবে না। তবে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে অভিযোগ রয়েছে, এমন ৩০ হাজার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে।
রাষ্ট্রীয় অর্থ ও প্রচুর সময় ব্যয়ের পরও প্রকৃত এবং নির্ভুল মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করা হবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথম আলোর কাছে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রণীত মুক্তিবার্তাকে (লাল বই) সঠিক ধরে নিয়ে মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করবে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর ধরে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি সরকারের সময় ৪৪ হাজার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় (২০০৯-২০১৪) তালিকাভুক্ত হওয়া সাড়ে ১১ হাজারের বেশির ভাগই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও লাল মুক্তিবার্তায় অনেকের নাম রয়েছে। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সই স্ক্যান করে সনদ জাল করেছেন। কেউ কেউ জেনারেল এম এ জি ওসমানীর খোদাই করা (এমবোস) স্বাক্ষর জাল করেছেন। এ ছাড়া জেলা-উপজেলা কমান্ডারের সই জাল করে বা যাচাই-বাছাই না করে সনদ দেওয়ার অনেক অভিযোগ এসেছে। এ জন্যই নতুন তালিকা করা জরুরি মনে করেন মন্ত্রী।
বারবার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বদলের বিষয়ে মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, বারবার সংজ্ঞা বা ধরন কিংবা মানদণ্ড বদলেছে, এটা ঠিক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) বৈঠকেও বেশ কয়েকবার এসব বিষয় চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা ছিল না। তাই এবার নির্দিষ্ট করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

ছয়বার তালিকা প্রণয়ন: মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মতে, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে নতুন তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করতে গিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়েছে। কোনো কোনো এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিভিন্ন পদেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুকেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এর আওতায় ’৮৬-৮৭ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সংগৃহীত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের (ইবিআরসি) তালিকা এবং ভারত থেকে প্রাপ্ত তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়, যা জাতীয় তালিকা নামে পরিচিত; এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন।

১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল আমিন আহমদ চৌধুরী বীর বিক্রম ইবিআরসিতে রাখা ভারত সরকার থেকে প্রাপ্ত তালিকা সংগ্রহ করে, যা ইবিআরসি বা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা বলে পরিচিত; এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন।

১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তৎকালীন আহ্বায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ জ ম আমিনুল হক বীর উত্তম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচন পরিচালনার ভোটার সূচক তালিকা প্রণয়ন করেন, যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৮৬ হাজার।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (সবুজ) হিসেবে পরিচিত, পরে আরও যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের আরেকটি তালিকা করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (লাল) হিসেবে পরিচিত।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইনকে আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মমতাজ উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি করা হয়। এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং এ থেকে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের তালিকার গেজেট প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে গেজেট আকারে প্রকাশিত তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, চারদলীয় জোট আমলে ৭০ হাজারের বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরপর তারাও জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়।

কিন্তু দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একইভাবে নতুন করে আরও সাড়ে ১১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নিয়ম লঙ্ঘন করে গেজেট প্রকাশ করায় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ২ হাজার ৩৬৭ জনের তালিকাসহ মোট তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ ইতিমধ্যে বাতিল করে দেয়। পরে এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে।

জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে জেলা প্রশাসক, সাংসদ বা প্রশাসনিক লোক দিয়ে বারবার তালিকা বা সংজ্ঞা নির্ধারণ করার ফলাফল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পাচ্ছেন না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করতে হলে গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে যাচাই-বাছাই করতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নতুন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স নির্ধারণ করা হলো কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কোনো মতামত নেওয়া হলো না। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যে সুবিধা দেয়, তার অপব্যবহার হচ্ছে। যাঁরা কর দেন নিয়মিত, তাঁদের তো ১০ হাজার টাকা ভাতার দরকার নেই। আর্থিকভাবে অসচ্ছল আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা যেন এই সুবিধা পান, সে জন্য একটি নীতিমালা করা দরকার।

মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১০ বার পরিবর্তন: মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বারবার পরিবর্তন করে বিভিন্ন সরকার তাদের মতো করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করেছে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কারা বিবেচিত হবেন, তা প্রথম নির্ধারিত হয় ১৯৭২ সালে। এরপরও বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মানদণ্ড কী হবে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) বৈঠকেও এ বিষয়ে কয়েক দফায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা বৈঠকের কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।

 বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ১৯৭২ সালে ইংরেজি ভাষায় জারি করা এক আদেশে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।

এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের উদ্যোগে নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা।

২০০২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত নীতিমালায় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার মানদণ্ডে নতুন করে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত সাময়িক সনদ অথবা জাতীয়ভাবে প্রস্তুত হওয়া চারটি তালিকার মধ্যে যাঁদের নাম কমপক্ষে দুটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও বাংলাদেশ রাইফেলস থেকে পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত আছে অথবা পরবর্তী যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যাঁদের গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা হবে, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা।

 আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীদের অবসরের বয়স বাড়ানোর ঘোষণার পর ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাঁদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ নিয়েছেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি এক বছর চাকরি করার সুযোগ পাবেন।

২০১১ সালের ৬ মার্চ একই ধরনের আরেকটি চিঠি জারি করা হয়। এসব মানদণ্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক উঠলে ২০১৪ সালের আগস্টেমুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা আদেশে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদ রয়েছে জানালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাবেন।

মন্ত্রণালয়ের এই আদেশ নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, চাকরি গ্রহণকালে এবং পরবর্তী সময়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দেননি বা মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ নেননি, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিজের হাতে ওই সারসংক্ষেপের ওপর লেখেন, ‘যাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাঁরা যে অবস্থায়ই হোক, সুবিধা পাবেন।’

ওই সারসংক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গত ১ অক্টোবর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনার উল্লেখ করে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জারি করা ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর এবং ২০১১ সালের ৬ মার্চ জারি করা চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর নির্ণায়ক হিসেবে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা অনুসরণ করতে হবে।

২০১৪ সালে পুনরায় জামুকার বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধার উপাধি বা সনদ পাওয়ার জন্য আট যোগ্যতার কথা বলা হয়। সেগুলো হলো: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করা; মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে ভূমিকা রাখা; কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আনসার বাহিনীর মতো বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীর সদস্য থাকা; প্রথমে ভারতের ত্রাণশিবিরে অবস্থান করলেও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া; পুলিশ, আনসার ও সেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া; মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অথবা মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত গণপরিষদের সদস্য হওয়া; মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক হিসেবে বা বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অবদান রাখা প্রভৃতি।

একই বছর জামুকার আরেক বৈঠকে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যেকোনো আবেদনকারীর বয়স ১৯৭১ সালে ন্যূনতম ১৫ বছর হওয়া বাধ্যতামূলক। এই সিদ্ধান্তের পর ১৩ বছর বয়সী শহীদুল ইসলাম লালু, ১৪ বছর বয়সী তারামন বিবি ও আবু সালেকদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির কী হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অনেকে দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁদের বয়স ১৫ বছরের বেশি হলেও এসএসসির সনদে তাঁদের বয়স কম দেখানো হয়েছে।

এরপর গত জুলাইয়ে জামুকার বৈঠকে আবারও সিদ্ধান্ত হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ যাঁদের বয়স ন্যূনতম ১৩ বছর ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারবেন। পরে দেখা যায়, ১৩ বছরের কম বয়সীদেরও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

 মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মেজর (অব.) এ এস এম শামসুল আরেফিন হতাশা প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসেই তালিকা বদল করে। এ ছাড়া যেভাবে সহযোগী, লেখক, শিল্পীসহ নানাজন তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন, তাতে একে আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বলা যাবে না। এটা এখন স্বাধীনতাসংগ্রামীদের তালিকা হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সেক্টরভিত্তিক, যাচাই-বাছাইও সেভাবে করা উচিত। কিন্তু সাংসদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এসব যাচাই-বাছাই করছেন।’

আবারও যাচাই-বাছাইয়ের ঘোষণা ও হাইকোর্টে রিট: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আবার মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। যাঁরা এখনো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হননি, তাঁদের ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে অনলাইনে আবেদন করতে বলা হয়। ২০১৫ সালে শুরু হয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। কথা ছিল ২০১৫ সালের ২৬ মার্চের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।

কিন্তু গত বছর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সোহরাবসহ ছয়জনের দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ঠিক না করেই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। গত ৮ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে ওই রিট নিষ্পত্তি হলে মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণের বিষয়টি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আলোকে ৬ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। গত মাসে জামুকার বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে আগামী ৭ জানুয়ারি থেকে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

নতুন সংজ্ঞায় বেড়েছে পরিধি: মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধার বয়স ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ন্যূনতম ১৩ বছর হতে হবে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণ করে গত ৬ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে এই বয়সের কথা বলা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন। এর মধ্যে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন; যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন; যেসব বাংলাদেশি বিশিষ্ট নাগরিক বিশ্বে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন; যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনীর যেসব সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন; মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ এবং এমপিএরা (গণপরিষদ সদস্য); পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত নারীরা (বীরাঙ্গনা); স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীরা এবং দেশ ও দেশের বাইরে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিকেরা, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক দলের (মেডিকেল টিম) চিকিৎসক, নার্স ও সহকারীরাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন।

সুবিধার জন্যই সংখ্যা বেড়েছে: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা প্রথমে দুই বছর এবং পরে আরও এক বছর বাড়িয়ে দেয়। এরপরই নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর সন্তানদের জন্য বাড়ানো হয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনির জন্য নির্ধারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির ঘটনাও বেড়েছে।

এ ছাড়া সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির পদ সংরক্ষণ করা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৮০টি আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি দুস্থ মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়া ও মেয়ের বিয়ের জন্য আবেদন সাপেক্ষে অনুদানও পান। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি হাসপাতালে সব রকম স্বাস্থ্যপরীক্ষা বিনা মূল্যে করাতে পারেন। ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড আছে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ও আসনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা সরকারের নির্দেশনায় বলা আছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ চাকরি কোটা রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও তালিকায় এত রদবদল সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়তি সুবিধা দিয়েই এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যদি এখন ঘোষণা দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে না এবং আহত ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছাড়া আর কাউকে কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না, তাহলে কাল থেকে আর কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলতে চাইবে না।

বারবার তালিকা বদল হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে উল্লেখ করে ​তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকা করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা যখন মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, কোনো কিছু আশা করে যাননি, এটাই তাঁদের মহত্ত্ব। এসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত নির্যাতনের শিকার নারী, বিধবা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বা অসহায়দের। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কেন এ সুবিধা পাবেন? এসব বন্ধ করা উচিত। আর কোনো তালিকা করা উচিত হবে না। নইলে এই অবিচার চলতেই থাকবে।

মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, তালিকা হওয়া উচিত ছিল রাজাকারদের। ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আর দফায় দফায় সংজ্ঞা বদল চিন্তাও করা যায় না। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সংজ্ঞা হয়েছে, সেটাই মানা উচিত বলে মনে করেন তিনি।