খুলনা শহরে মানুষ কমছে
>২০০০ সালে জনসংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৪৭ হাজার। ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৩৫ হাজারে: ইউএন হ্যাবিট্যাট
দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর খুলনার জনসংখ্যা বাড়ছে না, বরং কমছে। এক দশকে খুলনার জনসংখ্যা প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় মানুষ খুলনা শহর ছেড়ে যাচ্ছে।
একের পর এক শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ায় খুলনার শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। পরিবার নিয়ে তারা অন্য জেলায় চলে গেছে। ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ না থাকায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। আশপাশের উপজেলার মানুষের খুলনায় বসতি গড়ার প্রবণতা যেমন কমেছে, তেমনি শিক্ষা ও জীবিকার তাগিদে খুলনা শহরের মানুষ আগের চেয়ে বেশি হারে অন্য জেলায় যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে জনসংখ্যায়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক আধুনিকায়ন ধারার বাইরে পড়েছে খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। ফারাক্কার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও পড়েছে এই অঞ্চলে। তাই উন্নয়নে পিছিয়ে খুলনা। উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ারই কথা। তিনি বলেন, ‘দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে এই অঞ্চলের অবদান রাখার যে সুযোগ ছিল, সার্বিকভাবে বড় কোনো পরিকল্পনা না থাকায় সেটা হচ্ছে না।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক উল ইসলাম বলেন, খুলনার জনসংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। তবে সরকারের হাতে নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে খুলনা ছেড়ে যাওয়া মানুষের হার কমবে।
শহরের প্রাণকেন্দ্র ক্লে রোডে ৭৫ বছর ধরে ব্যবসা করছে ‘হুগলী বেকারি’। এই দোকানের একজন মালিক মো. মাজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশির দশকে খুলনা ছিল জমজমাট, ব্যবসাও ছিল চাঙা। নিউজপ্রিন্ট মিল, পাটকল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পর খুলনায় কেমন জানি মরা মরা ভাব চলে আসে। ব্যবসা যে হারে হওয়ার কথা ছিল, তা আর নাই। গোপালগঞ্জসহ আশপাশের শহরগুলোর যেভাবে উন্নয়ন হচ্ছে, খুলনার সেভাবে হচ্ছে না।’
মানুষ কমছে: আবাসনবিষয়ক জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএন হ্যাবিট্যাট ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে খুলনা শহরে মানুষ কমছে সেই তথ্য সবার সামনে হাজির করে। ‘দ্য স্টেট অব এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক সিটিস ২০১৫’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে জনসংখ্যা কমছে বিশ্বের এমন ২০ শহরের একটি তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় স্থান পেয়েছে খুলনা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সালে খুলনা শহরের জনসংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৪৭ হাজার। ২০১৪ সালে জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৩৫ হাজারে। ১৪ বছরে মানুষ কমেছে ২ লাখ ১২ হাজার।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদনও বলছে, খুলনা শহরের জনসংখ্যা কমছে। গত মাসে প্রকাশিত ‘আরবানাইজেশন অ্যান্ড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ’ নামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদমশুমারি অনুযায়ী, ২০০১ সালে খুলনার জনসংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৭৩ হাজার। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৬ হাজারে।
ইউএনএফপিএর গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এ কিউ এম মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাকিস্তান আমলের পর খুলনায় শিল্পকারখানা গড়ে তোলার আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার পর খুলনা এখন অনেকটাই মুমূর্ষু নগরের মতো।’
জনসংখ্যা কেন কমছে: ছোট ও বড় ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনাকে বসবাসের বা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী করার কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘সাউথ এশিয়াস টার্ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে কর্মসংস্থানে দেশের শীর্ষ পাঁচ শহরের তালিকায় খুলনা ছিল পঞ্চম। ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মসংস্থান ছিল খুলনা শহরে। ২০১২ সালের পাঁচটি শহরের তালিকায় খুলনা নেই। ২ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে তালিকার পঞ্চম স্থানে সিরাজগঞ্জ।
খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, একটা মিল বা কারখানাকে কেন্দ্র করে অনেক ব্যবসা গড়ে ওঠে। নিউজপ্রিন্ট, দেশলাই বা পাটকলের কারণে অনেক মানুষ জীবিকার সন্ধানে খুলনায় আসত। এসব বন্ধ হয়েছে। নতুন কারখানা বা কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। জীবিকার সন্ধানে অনেকে পরিবার নিয়ে খুলনা ছেড়ে যাচ্ছে।
মেয়র বলেন, শহরে পানির স্তর যেমন কমছে, অন্যদিকে সামান্য বৃষ্টিতে শহর তলিয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত শহর খুলনা। শহরের উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ খুবই কম। এটা জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সমস্যা।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসানুল হক মিয়া বলেন, ‘মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই খুলনায় নেই। শহরে কোনো আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) সেবা নেই। আমার হঠাৎ বিপদ হলে আমি কোথায় যাব? এসব কারণে মানুষ এ শহরে ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।’
কী করার আছে: পদ্মা সেতু, মোংলা ইপিজেড, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, খানজাহান আলী বিমানবন্দর—এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে খুলনায় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে বলে আশা করেন সরকারি কর্মকর্তারা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক উল ইসলাম বলেন, ‘হাতে নেওয়া প্রকল্পগুলো শেষ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোদমে শুরু হবে। খুলনা-যশোর মহাসড়কের দুপাশে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে।’
এতে ভিন্নমত পোষণ করেছেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু বা ভারতকে ট্রানজিট দিলেই খুলনার অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না। খুলনায় বি-শিল্পায়নের (ডিইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন) যে ধারা শুরু হয়েছে, তাতে সেখানে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তোলা কঠিন। দরকার সার্বিক বড় পরিকল্পনা হাতে নেওয়া।’