অস্তিত্বের সংকটে ৩৫০ বছরের সঙ্গতটোলা গুরুদুয়ারা

শ্রীশদাস রোডের ১৪ নম্বর বাড়িটি আশপাশের অন্য বাড়িগুলোর চেয়ে আলাদা। পুরোনো দোতলা বাড়ির ঘোরানো বারান্দাটা বাইরে থেকেই চোখে পড়ে। ছাদে বাঁশের খুঁটির ওপর কমলা রঙের নিশান উড়ছে। দেয়ালে নীল রঙের চাকতি আর তরবারির চিহ্ন। বাড়ির সামনের অংশে দুটি জরাজীর্ণ সাইনবোর্ডে ইংরেজি, বাংলা আর গুরুমুখী হরফে লেখা আছে নাম, ‘সঙ্গতটোলা গুরুদুয়ারা’।
বাংলাবাজারের এই তস্যগলির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় সাড়ে তিন শ বছরের পুরোনো এই নিদর্শনটি এখন জরাজীর্ণ। কিছু অংশ দখল হয়ে গেছে। সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের তালিকায়ও এর নামটি নেই।
শিখদের উপাসনালয়কে বলে গুরুদুয়ারা। বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের সহযোগী নয়জন গুরুর নবম গুরু তেগ বাহাদুর সিং ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৬৬৫ সালে ঢাকায় আসেন। তাঁর ঢাকাবাসের দুই বছরের কোনো এক সময়ে তিনি সঙ্গতটোলা গুরুদুয়ারা তৈরি করেন। ঢাকার টিকে থাকা দুই গুরুদুয়ারার অপরটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
সঙ্গতটোলা গুরুদুয়ারার দোতলা ভবনটির এখন প্রায় ভগ্নদশা। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পুরাকীর্তির তালিকায় এই স্থাপনাটি নেই। এলাকাবাসীও এই প্রাচীন নিদর্শন সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। গত মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় অফিসরুমের দেয়ালে পলেস্তারা খসে ভেতরের লাল ইট বেরিয়ে গেছে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ডান অংশের দেয়াল অনেক আগে থেকেই ভাঙা। সিঁড়িসংলগ্ন একটি চওড়া দেয়ালের ভাঙা অংশ দেখে মনে হয়, সেখানে এক বা একাধিক ঘর ছিল। ওপরের তলায় প্রার্থনাঘর। সেখানে তুলট কাগজে লেখা শিখ ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহেব রাখা।
মূল প্রার্থনা ভবনের উল্টো দিকে একই সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে একটি একতলা ভবনে বেশ কিছু মানুষের বাস। তাঁদের একজন বললেন, তাঁরা স্থানীয় মানুষ। কয়েক পুরুষ ধরে এখানেই থাকেন। গুরুদুয়ারার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটিও বললেন।
সঙ্গতটোলা গুরুদুয়ারার অফিসে কাউকে পাওয়া গেল না। নিরাপত্তারক্ষীর পরামর্শে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে গিয়ে জানা গেল বিস্তারিত। গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটি বাংলাদেশের (আরইজিডি) সদস্য শ্যাম দাস বললেন, গুরুদুয়ারা নানকশাহীর সেবকেরাই সঙ্গতটোলা গুরুদুয়ারার দেখভাল করেন। প্রতিদিন সকালে এখান থেকে একজন ‘গ্রন্থী’ বা প্রার্থনা পরিচালনাকারী সঙ্গতটোলায় গিয়ে প্রার্থনা করেন। আর প্রতি শনিবার কীর্তনের আয়োজন করা হয়, যেখানে স্থানীয় কয়েকজন শিখ ধর্মাবলম্বী তাতে যোগ দেন।
ঢাকার দুটিসহ বাংলাদেশের পাঁচটি গুরুদুয়ারা এই কমিটির অধীনে পরিচালিত হয়। শ্যাম বলেন, এগুলো পরিচালনার তহবিল আসে ভারতে শিখদের ধর্মীয় সংগঠন ‘কারসেবা সারহালি’ থেকে। বাংলাদেশ সরকার থেকে গুরুদুয়ারার জন্য কোনো তহবিল পাননি তাঁরা। বরং অবহেলার কারণেই হারিয়ে গেছে ইংলিশ রোডের মোহন সিং গুরুদুয়ারা। গুরুদুয়ারা নানকশাহীর প্রধান পরেশ লাল বেগী বললেন, নিজেদের অর্থায়নেই সঙ্গতটোলা গুরুদুয়ারাটি সংস্কারের পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।
গুরুদুয়ারাটির বিষয়ে জানতে চাইলে আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী স্থপতি তৈমুর ইসলাম খান বলেন, গুরুদুয়ারাটির বয়স প্রায় সাড়ে তিন শ বছর। মূল ভবন আরও আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন যা আছে, তা সংরক্ষণ করা হবে এমন শোনা গিয়েছিল। তবে এখনো তা হয়নি।
এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, গুরুদুয়ারাটি সম্পর্কে তিনি শুনেছেন। এটি সংরক্ষণের উপযোগী কি না, তা একটি দল পাঠিয়ে যাচাই করা হবে।