এত বিনিয়োগ তবু লোকসান

.
.

বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না রেলওয়ে। গত সাত বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও গতি বাড়েনি রেলের। সেবা না বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা ভাড়া বেড়েছে। এরপরও বাড়ছে লোকসান।
দীর্ঘদিন ধরে রেলে বিনিয়োগের হাহাকার ছিল। ছিল লোকবলের স্বল্পতা। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে রেলে অর্থায়ন বাড়তে থাকে। গত পাঁচ-ছয় বছরে ১০ হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ের বিভিন্ন নথি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত নথি অনুসারে, বর্তমানে রেলে উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে ৪৮টি। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। কিছু মাঝপথে আছে, আর কিছু কিছু প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে। গত সাত বছরে ৪০টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এ সময় শুধু রেল পরিচালনার জন্য ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পরিচালন লোকসানই হয়েছে ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর প্রকল্পের ব্যয় ধরলে লোকসান বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।এত বিনিয়োগ সত্ত্বেও রেলওয়ের সেবা বাড়ছে না, বাড়ছে লোকসান। কেন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ের এই বিনিয়োগ পরিকল্পিত নয়। যাত্রী বৃদ্ধি, আয়বর্ধক ও লাভজনক—এই তিন বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নানা বিবেচনা কাজ করেছে। তা ছাড়া আয়ের যে বিপুল সম্ভাবনা, তা ধরার কোনো উদ্যোগই নেই। দেশে এখন বছরে ২৩ লাখ কনটেইনার মালামাল পরিবহন হয়। এর ৯৩ শতাংশই হয় সড়কপথে। রেলওয়ে কেন পারবে না? এভাবে একটা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না।
তবে লোকসানের বিষয়ে মোটেও বিচলিত নন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রেল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। লোকসানের কথা বিবেচনা না করে শতভাগ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাঁর আশা, চলমান ৯৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লোকসান কমে আসবে। ২০১৮ সালের মধ্যে রেলের উন্নতি দৃশ্যমান হবে। আর ২০২০ সালের মধ্যে রেলের চেহারা পাল্টে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলে ব্যয় হয় দুই ধরনের। একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে, অন্যটি অনুন্নয়ন খাতে অর্থাৎ রেল পরিচালনায় দৈনন্দিন খরচ। উন্নয়ন বাজেটের অধীনে যে প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে এবং চলমান আছে—এর বেশির ভাগই নতুন রেললাইন ও সেতু নির্মাণ, ইঞ্জিন-বগি ক্রয়, অবকাঠামো নির্মাণ-সংক্রান্ত। অনুন্নয়ন খাতে বেশির ভাগ ব্যয় হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন-ভাতায়।
২০০৯ সালের জুলাই থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সাত বছরে রেলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। এসব অর্থ এসেছে বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরকারের বাজেট থেকে। বিদেশি ঋণ ও সহায়তাদানকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত। চীন অর্থ ছাড় না করলেও প্রস্তাবিত প্রকল্প ধরলে সবার ওপরে চলে যাচ্ছে চীন। আর এ সময় ট্রেন পরিচালনায় দৈনন্দিন ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই সাত বছরে রেলে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এই সময় রেল আয় করেছে ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো সুদে-আসলে ফেরত দিতে হবে। যখন ঋণের কিস্তি বেড়ে যাবে, তখন দেখা যাবে রেলের আয়ের চেয়ে ঋণের কিস্তির পরিমাণ বেশি।

গত পাঁচ বছরে রেলের ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এখন রেলের আন্তনগর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) শ্রেণির ভাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা পথে চলাচলকারী বিলাসবহুল বাসের প্রায় সমান।

রেল কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরই আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ নানা তথ্যসংবলিত একটি বই প্রকাশ করে। ঋণ ও সরকারের খরচে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, এর ব্যয় বইয়ে উল্লেখ করা হয় না। শুধু রাজস্ব খাতের ব্যয় এবং আয়ের হিসাব দিয়ে লাভ-লোকসান দেখানো হয়। এটাকে তারা বলে পরিচালন মুনাফা। কিন্তু স্বাধীনতার পর রেল পরিচালন মুনাফা দেখাতে পারেনি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলে ইঞ্জিন-বগির সংকট যায়নি। বর্তমানে রেলে ২৭৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর ৫৪ শতাংশের বয়স ৩৫ থেকে ৬৩ বছর। একই অবস্থা বগিরও।

২০০৫ থেকে ২০১১—এই সাত বছরে কোনো ইঞ্জিন কেনা হয়নি। গত পাঁচ বছরে কেনা হয়েছে ৪৬টি ইঞ্জিন। অন্যদিকে ২০০৬ সালের পর প্রায় এক দশক বগি কেনা হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে ২৭০টি নতুন বগি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বগি এসেছে।

তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকার যেভাবে রেলে বিনিয়োগ করছে, সেই তুলনায় ইঞ্জিন-বগি কেনার প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব কমই দেওয়া হয়েছে। একাধিক প্রকল্প চলমান থাকলেও আগামী দুই বছর নতুন ইঞ্জিন-বগি পাওয়ার সম্ভাবনা কমই। কারণ, এসব প্রকল্পের বেশির ভাগেরই অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। যেগুলোর হয়েছে, সেগুলোতে ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি।

সূত্র আরও জানায়, প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু অবকাঠামো উন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এসব অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ৮০ শতাংশেরই ঠিকাদার দুটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ। তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া গত বছর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হয়েছেন।

রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিপুল অর্থ পেয়ে রেলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়ে গেছে। এ জন্যই সাধারণ ইঞ্জিন ও বগির সংকট দূর না করে সবার আগে চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছে। পরে ডেমু একটি অজনপ্রিয় ট্রেনে পরিণত হয়। প্রকল্প নেওয়া থেকে শুরু করে নতুন ট্রেন চালু, এমনকি কোন স্টেশনে ট্রেন থামবে—সবকিছুই রাজনৈতিক ও ব্যক্তি বিবেচনা থেকে নেওয়া হয়েছে।

সেবা কি বেড়েছে?

শুধু কি লোকসান? রেলমন্ত্রী রেলকে সেবামূলক বললেও সেবা বাড়েনি মোটেও। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন ২০০০ সালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করত পাঁচ ঘণ্টায়। ১৬ বছর পর এখন ওই ট্রেনের নির্ধারিত সময় ছয় ঘণ্টা। কখনো কখনো এই সময়ও মেনে চলে না। নতুন কোচ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চালু করা সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনেরও নির্ধারিত সময় পৌনে ছয় ঘণ্টা। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের যাত্রা সময় তো আরও বেশি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথ সংস্কারের ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায় শেষ। অথচ এই পথ দিয়ে চলা কোনো ট্রেনের গতি বাড়েনি।

রেল পরিচালনার টাইম-টেবিল বই অনুসারে, ২০০১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় পুরোটাতেই ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করত। শুধু কুমিল্লার সদর রসুলপুর এলাকার কিছু অংশে ৭২ কিলোমিটার গতি ছিল। এখন পুরো পথেই ৭২ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, সম্প্রতি টঙ্গী-ভৈরব পথে নির্মাণ করা নতুন রেললাইন দিয়ে ট্রেন চালিয়ে গতি পরীক্ষা করেন রেলের কর্মকর্তারা। ওই ট্রেনে রেলের মহাপরিচালক নিজেই অবস্থান করছিলেন। এই পথে ট্রেন ৮০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর নির্দেশনা দিলেও সেই গতি তোলা যায়নি। একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান ইঞ্জিন দিয়ে চালালে ৮০ কিলোমিটার গতি তোলা কঠিন। আবার রেলের লাইন মেরামতে এতই ফাঁকিবাজি হয়েছে যে, গতি তুলতে গেলেই ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১৮০ কোটি টাকায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার করা হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, বাস্তবায়ন শেষে এই পথে ৬৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। কিন্তু এখন চলে ৫০ কিলোমিটারেরও কম গতিতে।

লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত বিদ্যমান রেললাইন পুনর্বাসনে ১৭০ কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। কিন্তু ওই পথে ট্রেনের গতি বাড়েনি, বরং কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

রেলের নথিপত্রে আন্তনগর ট্রেনের ৯০ শতাংশ সময় মেনে চলছে বলে দেখানো হয়েছে। আসলে প্রতিটি ট্রেনেরই চলাচলের সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে দেরিতে চললেও তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। এ ছাড়া বাস্তবতা হচ্ছে, আধা ঘণ্টা দেরিতে চলা ট্রেনকে সময় মেনে চলা হিসেবেই গণ্য করে রেল কর্তৃপক্ষ।

ট্রেন পরিচালনা-সংক্রান্ত দৈনন্দিন হিসাব থেকে দেখা গেছে, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটলে পুরো সপ্তাহের ট্রেন চলাচলের সময়সূচি উল্টে যায়। তখন আট ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ট্রেন চলে। আর রেলে দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই লাইনচ্যুতির ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে রেলের পূর্বাঞ্চলেই ৪৮টি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। বিপুল বিনিয়োগের পরও এভাবে লাইনচ্যুতির ঘটনাকে অস্বাভাবিকই মনে করেন রেলের অনেক কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যাত্রী হিসেবে বলতে পারি, রেলে সেবা বাড়েনি। গতিও আগের মতোই আছে। বিপুল বিনিয়োগের পরও এক জায়গায় আটকে থাকার কারণ হতে পারে, বিনিয়োগ পরিকল্পিত হয়নি। আবার লুটপাটের কারণেও এমনটা হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে বড় প্রকল্প মানে বড় দাঁও মারা। রেলেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের আমলে রেলপথে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এখনো অনেক লাইন জরাজীর্ণ। ফলে গতি বাড়াতে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। এখন সময়মতো ট্রেনের যাতায়াত নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। গতিও বাড়বে আস্তে আস্তে।

কেন এগোচ্ছে না?

রেলের কর্মকর্তা, রেল নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে রেলের এই দুরবস্থার পেছনে তিনটি বড় কারণ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের মতো দক্ষ কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যাত্রী সুবিধা বা আয়বর্ধক প্রকল্প না নিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার প্রকল্প নেওয়া। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক, ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করেছে।

প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার যে অভাব রয়েছে, তা রেলওয়ের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের চিত্র থেকেই স্পষ্ট। রেল পরিচালনা-সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, গত অর্থবছরে রেল যাত্রী পরিবহন করেছে সাত কোটি। আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। যা রেলের নিজেরই ঠিক করা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশ কম।

রেলের হিসাব বলছে, গত বছর যে পরিমাণ যাত্রী বেড়েছে, তা গতানুগতিক। কারণ, গত এক দশকে রেলের যাত্রী ৫-৬ শতাংশ কম-বেশি হচ্ছে। কখনো এক বছর বেড়েছে, আবার পরের বছর কমেছে। কখনো দুই বছর বৃদ্ধির পর এক বছর কমে গেছে। একই অবস্থা মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রেও। তবে মালামাল পরিবহনের বৃদ্ধির চেয়ে কমার প্রবণতাই বেশি।

রেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে বড় অর্জন না হওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ পাওয়া গেছে। মূল সমস্যা ইঞ্জিন ও বগির স্বল্পতা। ২০১৪ সালের আগে প্রায় এক দশক ইঞ্জিন ও বগি কেনা হয়নি বললেই চলে। এখন অবশ্য ইঞ্জিন-বগি আসছে, তবে পুরোনো ইঞ্জিন-বগি অকেজো হওয়ার পর। ২০০৯ সাল থেকে বিপুল পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করলেও শুরুতে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর বেশির ভাগই রেললাইন ও সেতু নির্মাণ, স্টেশন আধুনিকায়ন আর মেরামতের কাজে।

একমাত্র ইঞ্জিন ও বগি কেনার একটি প্রকল্পই দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে, তা হচ্ছে ডেমু প্রকল্প। চীন থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় ২০টি ডেমু কেনা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রেলেই তুমুল বিতর্ক আছে।

রেলের টিকিট বিক্রির পদ্ধতিও যাত্রীবান্ধব নয় বলে মনে করেন যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো। রেলের কর্মী, সেনাবাহিনী ও বিচারপতির জন্য ১০ শতাংশ টিকিট সংরক্ষণ করে রেলওয়ে। তবে এই ঘোষিত সংরক্ষণের বাইরে প্রায় অর্ধেক টিকিটই কম্পিউটারে ব্লক করে রাখা হয় ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের জন্য।

রেলমন্ত্রীর দাবি, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের পুরোটা দুই লাইন এবং আরও কিছু নতুন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন বেড়ে যাবে।

রেল যোগাযোগের অবস্থা

স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ যে রেললাইন পেয়েছে, ৪৫ বছরে তা বেড়েছে মাত্র ১৯ কিলোমিটার। রেলের পথকে বলা হয় রুট কিলোমিটার বা মোট রেলপথ। আর রেলপথের কোথাও কোথাও একাধিক লাইন রয়েছে। রেলপথে থাকা সব লাইনের যোগফলকে বলে গজ কিলোমিটার বা রেললাইন। স্বাধীনতার পর রেললাইন কমেছে ৩৫৫ কিলোমিটার। মূলত সরকারি গুদাম ও বন্দর-ঘাটের সঙ্গে সংযোগকারী অনেক রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে।

স্বাধীনতার সময় রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। এখন রেলপথ আছে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। আর বর্তমানে রেললাইন আছে ৪ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। স্বাধীনতার সময় রেললাইন ছিল ৪ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার।

বর্তমানে দেশের ৪৪ জেলায় রেল যোগাযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি জেলায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ আছে। এই জেলাগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, লালমনিরহাট, জামালপুর ও কুমিল্লা। এসব জেলায় স্টেশনও বেশি।

রেলে তিন ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে। এগুলো হচ্ছে মিটারগেজ, ব্রডগেজ ও মিশ্রগেজ। প্রতিটির কারিগরি দিক আলাদা। ফলে রেল পরিচালনায় সমন্বয় করা কঠিন। রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রায় পুরোটাই মিটারগেজে চলে। আর পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ ট্রেন চলে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মিটারগেজ লাইন তুলে দেওয়া হচ্ছে।

করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, রেলকে বাঁচাতে হলে মালামাল পরিবহন বাড়াতেই হবে। এখন সব চাপ পড়ছে সড়কে। এভাবে সড়কে চাপ বাড়লে সড়কও ভেঙে পড়বে। তাই রেলে মালামাল পরিবহন বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি দ্রুত একটি করপোরেশন গঠন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের এমন কিছু নীতি-সুবিধা ঘোষণা করতে হবে, যাতে রেলে মালামাল পরিবহনে সবাই উৎসাহী হয়। আর যাত্রী পরিবহন বাড়ানোর একটাই পথ, তা হচ্ছে সেবা বৃদ্ধি। এ জন্য কিছু কিছু সেবা সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনার ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।