প্রবীণ আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদ নৃশংসভাবে খুন

আফতাব আহমেদ
আফতাব আহমেদ

নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ আলোকচিত্র সাংবাদিক আফতাব আহমেদ (৭৮)। রাজধানীর রামপুরায় নিজ বাড়ির শয়নকক্ষ থেকে পুলিশ গতকাল বুধবার দুপুরে তাঁর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মুহম্মদ মারুফ হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, আফতাবকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িচালক কবিরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিহত আলোচিত্রীর মেয়ে আফরোজ আহমেদের অভিযোগ, তাঁর বাবা বাসায় টাকা রাখতেন। এ টাকা লুট করতেই কবিরের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে আলোচিত অসংখ্য ছবি তুলেছিলেন আফতাব আহমেদ। তাঁর তোলা ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব ইত্যাদি। তবে আফতাব আহমেদ সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় তোলা ‘জাল পরা বাসন্তি’র ছবির কারণে। বাসন্তির সেই ছবি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরি করার পর ১৯৬৪ সালে দৈনিক ইত্তেফাক-এ ফটোসাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। টানা কাজ করার পর দৈনিক ইত্তেফাক থেকে ২০০৬ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন তিনি। ওই বছরই একুশে পদক পান আফতাব আহমেদ।
১৯৩৫ সালে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া থানার মহিপুরে জন্মগ্রহণ করেন আফতাব আহমেদ। তিনি ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ও জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি, বাংলার মুক্তির সংগ্রাম সিরাজুদৌল্লা থেকে শেখ মুজিব, আমরা তোমাদের ভুলবো নাসহ কয়েকটি বইও আছে তাঁর।
আফতাব আহমেদের পারিবারিক সূত্র জানায়, তিনি ৬৩ পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডে চারতলা বাড়ির মালিক ছিলেন। তিন বছর আগে স্ত্রী মমতাজ বেগম মারা যাওয়ার পর তিনি ওই বাড়ির তিনতলায় একা থাকতেন। দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে মনোয়ার আহমেদ থাকেন যশোরে। আর মেয়ে আফরোজ আহমেদ তাঁর স্বামী ফারুক আহমেদের সঙ্গে থাকেন গাজীপুরে। খণ্ডকালীন গৃহকর্মী নাসিমা আক্তার রান্না করে দিয়ে চলে যেতেন।
পুলিশ জানায়, আফতাবের জামাতা ফারুক আহমেদের ফোন পেয়ে গতকাল সকাল নয়টার দিকে পুলিশ ওয়াপদা রোডের বাড়িতে যায়। সেখানে গৃহকর্মী নাসিমা উপস্থিত ছিলেন। তিনতলায় লোহার ফটকের তালা ভেঙে পুলিশ বাসায় ঢোকে। পুলিশ শোয়ার ঘরের মেঝেতে তাঁকে পড়ে থাকতে দেখে। তাঁর দুই হাত-পা বাঁধা, গলায় তোয়ালে পেঁচানো ছিল। গলায়-গালে ছিল কামড়ের জখম। বাসার তিন কক্ষের দরজাই খোলা ছিল।
উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বাসার স্টিলের আলমারি ভাঙা ও মালপত্র তছনছ করা ছিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মারুফ হাসান বলেন, দেখে মনে হচ্ছে, ডাকাতি বা টাকা আত্মসাৎ করতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
বেলা একটার পর পুলিশ আফতাবের মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। এ সময় গৃহকর্মী নাসিমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এর আগে নাসিমা প্রথম আলোকে জানান, সকাল সাড়ে আটটার দিকে তিনি কাজে এসে দেখেন আফতাবের বাসায় ঢোকার লোহার ফটকের বাইরে তালা ঝুলছে। ডাকাডাকি করেও তিনি সাড়া পাননি। পরে পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেন আফতাবের লাশ পড়ে আছে। এরপর তিনি আফতাবের মেয়েকে ফোন করে তাঁর মৃত্যুর খবর দেন।
পাশের বাড়ির আবুল হোসেনের স্ত্রী বলেন, ‘সকালে কাজের বুয়া নাসিমা এসে জানায়, খালুজান আর নেই।’ আফতাব দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন, তাই তিনি মনে করেছিলেন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। আফতাব খুন হয়েছেন, তা তিনি বুঝতে পারেননি। মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত তাঁরা আফতাবের বাসা থেকে কোনো শব্দ পাননি।
আফতাব আহমেদের মেয়ে আফরোজ আহমেদ জানান, সম্প্রতি পুরান ঢাকার আর কে মিশন রোডের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে সেই টাকা তাঁর বাবা বাসায় রেখেছিলেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা ছবির স্বত্ব বিক্রি করে পাওয়া ১৫ লাখ টাকাও বাসায় রেখেছিলেন। কোনো অর্থ ব্যাংকে রাখতেন না। কবির নামের এক যুবককে ১ ডিসেম্বর ব্যক্তিগত গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ দেন তাঁর বাবা। কবির তাঁর বাবাকে খুন করে টাকা নিয়ে পালিয়েছেন।
আফতাব আহমেদের ঘনিষ্ঠজন আলোকচিত্রী সাংবাদিক মো. জহিরুল হক বলেন, আফতাবের কোনো শত্রু ছিল না। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে তিনি অনেক দুর্লভ ছবি তুলেছেন। গ্রামের বাড়িতে তাঁর নামে মাদ্রাসা ও মসজিদ রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তাঁর মরদেহ সেখানের হিমঘরে রাখা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর লাশ ওয়াপদা রোডের বাসায় নেওয়া হবে। বাদ জোহর প্রেসক্লাবে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নেরর একাংশ (ডিইউজে), বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ও রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা পৃথক বিবৃতিতে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে।