জীবনের কোলাহলে বেঁচে আছেন শেফালী ঘোষ

কর্ণফুলীপাড়ের দুই তীরের আনন্দ-বেদনার গল্প সুর তুলেছিল শেফালী ঘোষের কণ্ঠে। তাঁকে হারিয়ে চট্টগ্রামবাসীর কেটে গেল সাত বছর। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যু দিন। 
শেফালী ঘোষের গানে এই জনপদের সংস্কৃতি, জীবনাচার এবং মানুষের মনের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারবার। তাই সেই সব গান আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কর্ণফুলী যত দিন বয়ে চলবে, ততদিন শেফালী থাকবেন। কেননা তাঁর গানে সূর্য ওঠার অসাধারণ বর্ণনার সঙ্গে প্রিয় বিরহের বেদনা একাকার যেমন হয়েছে, তেমনি চিরপ্রবহমান জলধারা কর্ণফুলীর কথাও উঠে এসেছে—‘সূর্য উডের অভাই লাল মারি/ রইস্যা বন্ধু যারগই আমার বুকে শেল মারি’, ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত, লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী’। শেফালী ঘোষ বেশির ভাগ গান গেয়েছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। কিন্তু তাঁর সেই গানের সুর ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। আজও কোনো গানের আসরে শত শত দর্শক-শ্রোতা মাতোয়ারা হয়ে শোনেন তাঁর গান। 
শুরুতে নজরুলসংগীত ও আধুনিক গান করতেন শেফালী। ১৯৬৩ সালের কথা। বয়স তখন ২২। ওই সময় চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন আশরাফুজ্জামান। তিনি শেফালী ঘোষ আর আঞ্চলিক গানের সম্রাট শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবকে ডেকে পাঠালেন। 
প্রস্তাব দিলেন আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়ার। দুজনে রাজি হলেন। ডেকে আনা হলো মলয় ঘোষ দস্তিদারকেও। তিনি এই দুই শিল্পীর জন্য গান বাঁধলেন। এ গানের কথায় মানুষের অন্তরের আকুলতা যেন কর্ণফুলীর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে—‘নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি আইস্য তাড়াতাড়ি/ তোঁয়ারে ছাড়া খাইল্যা ঘরত থাইক্যুম কেন গরি?’ শেফালী ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সেই দ্বৈত কণ্ঠের গান নিয়ে হইচই পড়ে গেল। 
শেফালী ঘোষকেও আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান তাঁকে জনপ্রিয়তার এমন শীর্ষ এক পর্যায়ে নিয়ে গেল যে কোনো পালাগান, অনুষ্ঠান আর শেফালী ছাড়া জমল না। 
গ্রামে, গঞ্জে, পাড়ায় ছেলে-বুড়ো-যুবক সবার মুখে শেফালীর গান। তাই তো তাঁর জন্য গান লিখলেন উপমহাদেশখ্যাত রমেশ শীল, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার, কবিয়াল এয়াকুব আলী, সৈয়দ মহিউদ্দিন, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত দাশ, মোহাম্মদ নাসির, মোহন লাল দাশেরা। তাঁদের লেখা সেই সব গান শেফালীর জাদুকরি কণ্ঠে এসে মানুষের হূদয় কেড়ে নিল, আর তাদের মুখে ফিরতে ফিরতে এক ধরনের লোকগানের মর্যাদায় অমর হয়ে গেল। মানুষ কি ভুলবে সেই কথাগুলো— ‘আঁধার ঘরত রাত হাডাইয়ুম হারে লই’, ‘ও রে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা’, ‘পালে কী রং লাগাইলিরে মাঝি’, ‘সাম্পানে কী রং লাগাইলি’, ‘নাতিন বরই খা বরই খা হাতে লইয়া নুন’। আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো রয়ে যাবে শেফালীর গানে। শিল্পী হিসেবে শ্রেষ্ঠ যে পুরস্কারটি তিনি পেয়েছেন তা হচ্ছে, অগুনতি মানুষের ভালোবাসা। অবশ্য ২০০৬ সালে মৃত্যুর এক বছর পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছিলেন একুশে পদক। 
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর যখন উপদ্রুত উপকূল মৃত্যু-উপত্যকায় পরিণত হয়। তখন শেফালী গেয়ে উঠলেন তাঁর বিখ্যাত গান—ভাঙা গাছর নয়া টেইল/পাতা মেলি দেহার খেইল/পঙ্খি আবার উড়ের ফিরের/ চুপতে প্রেমের হথা হঅর। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে আবার জীবনের হাল ধরার এমন প্রেরণাদায়ী গান গেয়েছিলেন বলেই জীবনমুখী শিল্পী শেফালী ঘোষ বেঁচে আছেন জীবনের কোলাহলে।