তরুণের একটি মাস ফিরিয়ে দেবে কে?

১৫  মার্চ ভোলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন আকতার। ছবি: সংগৃহীত
১৫ মার্চ ভোলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন আকতার। ছবি: সংগৃহীত

সবুজ নামের এক যুবককে সাজার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অথচ বাদীপক্ষ বলছেন, সবুজ নামে যাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি মোটেও সবুজ নন। সবুজ নামে গ্রেপ্তার হওয়া যুবকের আসল নাম আকতার হোসেন। সবুজ তাঁর ডাকনাম। ঢাকার একটি আদালতের পরোয়ানা অনুযায়ী ভোলা থেকে এই যুবক গ্রেপ্তার হন। তবে ভোলা কারাগারে ২৮ দিন আটক থাকার ১৫ মার্চ বুধবার জামিনে ছাড়া পেয়েছেন এই যুবক।

কারাগার থেকে মুক্ত আকতার হোসেন আজ সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নাম আকতার হোসেন। সব সার্টিফিকেটে এ নামই আছে। জাতীয় পরিচয়পত্রেও আমার নাম আকতার হোসেন। সবুজ আমার ডাকনাম।’ যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তিনি পুলিশকে বলেছিলেন যে তিনি মামলার আসামি সবুজ নন। ঢাকায় কখনো বসবাস করেননি। এইচএসসি পাস আকতার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভোলা জেলার ট্রেড মার্কেটিং সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আকতার দাবি করলেন, ‘বিনা দোষে এক মাস জেল খেটেছেন। এখন মামলায় ঢাকার আদালতে হাজিরা দিতে হবে। অপরাধ না করেও আসামি হয়েছি। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চাই।’

রাজধানীর মিরপুর থানায় করা মামলার বাদীর বাবা জামসেদ আলী তালুকদার নিজ বাসায় প্রথম আলোকে বলেন, আট বছর আগে তাঁর ছেলে শান্ত আহমেদকে পিস্তল দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালান দক্ষিণ মনিপুর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী সবুজ। কিন্তু পুলিশ সবুজ নামের যে যুবককে গ্রেপ্তার করেছেন তিনি সবুজ নন। সন্ত্রাসী সবুজ পলাতক রয়েছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে শান্ত আহমেদ নামের এক যুবককে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ২০০৯ সালে মিরপুর থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় আসামি করা হয় মো. সবুজ ও মো. মনিরকে। পরে এই দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে সবুজ জামিন নিয়ে পলাতক থাকেন। ২০১৫ সালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত সবুজকে দুই বছর কারাদণ্ড দেন। খালাস পান মনির। তখন সবুজকে গ্রেপ্তার করার জন্য তাঁর নামে আদালত গ্রেপ্তার পরোয়ানা জারি করেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কাগজে তাঁর নাম লেখা হয় মো. সবুজ। বাবার নাম মো. আবদুস শহীদ ওরফে সহিদ মিয়া। গ্রাম তুলাতলী। জেলা ভোলা। এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাওয়ার পর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোলা থানার পুলিশ আকতার হোসেন ওরফে সবুজকে মো. সবুজ হিসেবে গ্রেপ্তার করে ভোলার আদালতে পাঠায়।

বাবা জামসেদ আলী তালুকদারের সঙ্গে শান্ত আহমেদ। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাবা জামসেদ আলী তালুকদারের সঙ্গে শান্ত আহমেদ। ছবি: আসাদুজ্জামান

আসল সবুজ নামের আসামির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সবুজকে মিরপুরের মণিপুরী এলাকার লোকজন সন্ত্রাসী হিসেবে চেনে। তাঁর বাবার নাম শহিদ মিয়া। সবাই ‘শহিদ কন্ডাক্টর’ হিসেবে চেনে। এই সবুজ রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। কয়েক বছর আগে তাঁর পায়ে গুলি লাগে। পরে আদালতে নিজেকে পঙ্গু দেখিয়ে জামিন নেন। এরপর থেকে তিনি পলাতক।

আকতারকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর বাবা রিকশাচালক আবু সাইয়িদ ছেলের ছবি নিয়ে মিরপুর মণিপুরী মধ্যপাড়ায় মামলার বাদী শান্ত আহমেদের বাসায় যান। তাঁদের দেখান তাঁর ছেলের ছবি। তাঁদের ছেলেকে যে সবুজ অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিলেন, তা এই তাঁর ছেলে কি না? জবাবে তাঁরা জানিয়ে দেন, এ সেই সবুজ নন। আসামি মো. সবুজের পরিবার থাকতেন দক্ষিণ মণিপুরী পাড়ায়। ওই বাসার মালিক রুনা জামান প্রথম আলোকে বলেন, সবুজরা তিন থেকে চার বছর আগে বাসা ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন তা তিনি জানেন না। সবুজ নামের আসামির পরিচিত কবির হোসেন বলেন, ছবির ব্যক্তি সবুজ নন।

আকতারকে গ্রেপ্তার করেন ভোলা সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ঢাকার আদালত থেকে মো. সবুজের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়। পরোয়ানা অনুযায়ী তিনি গ্রেপ্তার করেছেন। তাঁর নাম আকতার কি না তা তাঁর জানা নেই। ভোলা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল কবীর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সবুজকে গ্রেপ্তারের পর তিনি বলেননি যে তাঁর নাম আকতার হোসেন। তাঁর বাবার নাম আবু সাইয়িদ।

তবে ওই যুবকের বাবা রিকশাচালক আবু সাইয়িদ প্রথম আলোকে বলেন, যখন তাঁর ছেলেকে ধরা হয়, তখন পুলিশকে বলেছিলেন, তাঁর ছেলের নাম আকতার হোসেন। সবুজ তাঁর ডাকনাম। ঢাকায় জীবনে কোনো দিন তিনি থাকেননি। তারপরও পুলিশ তাঁর ছেলেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

আকতারের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ১২ মার্চ ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন ওই যুবক। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন ওই যুবক। তাঁর শুনানির দিন রয়েছে ২৭ এপ্রিল।

বাদীপক্ষ বলছেন, নয় বছর আগে ভিকটিম শান্ত আহমেদের বয়স ছিল ১৮ বছর। ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাঁর খালাতো বোন সুষমার মোবাইলসহ সোনার চেইন ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। পরে সুষমা জানতে পারেন, ছিনতাইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন সবুজ। সবুজের বাবা শহিদ কন্ডাক্টর সুষমার জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করলে শান্ত তাঁদের (সবুজদের) বাসায় যান। তখন সবুজসহ অন্যরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে শান্তর মাথায় কোপ দেন। এরপর থেকে শান্ত মানসিক ভারসাম্যহীন বলে জানান তাঁর বাবা জামসেদ আলী তালুকদার। ছেলে শান্তর এমন অবস্থার জন্য দায়ী মো. সবুজকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে তাঁর মা আনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, সবুজ তাঁর ছেলের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে।

বিষয়টি জানানোর পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ প্রশাসনের করণীয় হবে এ ঘটনা তদন্ত করে নিশ্চিত হওয়া যে ভুলক্রমে নিরপরাধ ব্যক্তিকে সাজার পরোয়ানা অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না। আপিল মামলায় সেই প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া এবং প্রকৃত সাজার আসামি সবুজকে গ্রেপ্তার করা।