বিক্রি হয়ে গেছে বধ্যভূমি

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বধ্যভূমি খুনিয়াদিঘি l প্রথম আলো
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বধ্যভূমি খুনিয়াদিঘি l প্রথম আলো

বিক্রি হয়ে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী বধ্যভূমি খুনিয়াদিঘি।
রানীশংকৈলের মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী দ্বিতীয় বড় ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল রানীশংকৈল উপজেলায়। রানীশংকৈল, পীরগঞ্জ ও হরিপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে আনা হতো ওই ক্যাম্পে। সেখানে চলত অমানুষিক নির্যাতন। আর নির্যাতনের পর তাঁদের ভান্ডারা গ্রামের খুনিয়াদিঘির পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো। হত্যার পর একের পর এক লাশ ফেলে দেওয়া হতো পুকুরের পানিতে।
আবু সুফিয়ান আরও জানান, খুনিয়াদিঘিতে মোট কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে স্বাধীনতার পর দিঘির পাড়ের গণকবর ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খুলি এবং হাড়গোড়ের সংখ্যা দেখে অনুমান করা হয়, সেখানে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। মানুষের রক্তে দিঘির পানির রং গাঢ় খয়েরি হয়ে ছিল অনেক দিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিঘি থেকে উদ্ধার করা মানুষের হাড়গোড় একটি গর্ত করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। পরে ওই জায়গাটিতে স্থাপন করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে খুনিয়াদিঘির শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হলেও বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যায়নি।
হোসেনগাঁও ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬২ সালের স্টেট একুইজিশনে (এসএ) খুনিয়াদিঘি জলকর (মৎস্য শিকারের অধিকার) হিসেবে মেহের বকস সরকারের ছেলে কুশুম উদ্দীনের নামে রেকর্ড ছিল। তবে সেখানে কোনো জমির পরিমাণ উল্লেখ ছিল না। ১৯৮২ সালে জমির পরিমাণ ২ দশমিক ১৮ একর উল্লেখ করে কুশুম উদ্দীনের ছেলে হামিদুর রহমান দিনাজপুরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে জমি খারিজের আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খারিজের আদেশ পান হামিদুর রহমান। হামিদুর রহমান উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সেই থেকে তাঁর নামে জমি খারিজের পর খাজনা দেওয়া শুরু হয়। হামিদুর রহমান সম্প্রতি রানীশংকৈলের ভান্ডারা গ্রামের আবুল কাশেমের স্ত্রী ফাতেমা বেগমের কাছে খুনিয়াদিঘিটি বিক্রি করে দেন।
রানীশংকৈল উপজেলা সহকারী সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সর্বশেষ ভূমি জরিপে খুনিয়াদিঘির জমিটি এখনো খাস খতিয়ান হিসেবেই আমাদের দপ্তরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ জমিটি বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।
মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসাহাক আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী খুনিয়াদিঘি। এই বধ্যভূমিটি কী করে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায় ভাবতে পারছি না।’ দ্রুত খুনিয়াদিঘি সরকারের আওতায় এনে তা সংরক্ষণে জোর দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে রানীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার মো. নাহিদ হাসান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি খুনিয়াদিঘি সংরক্ষণের পদক্ষেপ হিসেবে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখন আমরা সে জন্য কাগজপত্র তৈরি করছি।’
স্থানীয় সাংসদ মো. ইয়াসিন আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষী খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’