জঙ্গিগোষ্ঠীর আত্মঘাতী সদস্য ১৫ না ৩০?

.
.

আগামী কয়েক মাস পর বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা আঁটছিল নব্য জেএমবি। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকায় আস্তানা গড়ে বিস্ফোরকের মজুত ও সদস্যদের আত্মঘাতী হিসেবে গড়ে তুলছিল এই গোষ্ঠী। জঙ্গি দমনে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, এরই মধ্যে কয়েকটি আস্তানায় অভিযান চালানোর পর তারা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে।
গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার পর নতুন করে সংগঠিত নব্য জেএমবির মূল নেতৃত্বে কে বা কারা আছে এবং তাদের কাছে কারা আত্মঘাতী হওয়ার দীক্ষা নিচ্ছে, সংখ্যায় তারা কতজন, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি ইউনিটের কাছ থেকে দুটি আনুমানিক হিসাব পাওয়া গেছে। একটি ইউনিটের হিসাবে, এই পর্বে নব্য জেএমবির কাছে ৩০ জনের মতো প্রশিক্ষিত সদস্য আছে, যারা আত্মঘাতী হওয়ার জন্য প্রস্তুত। আরেক ইউনিটের হিসাবে এই সংখ্যা ১৫ জনের বেশি হওয়ার কথা নয়।
৩০ বা ১৫ জন—সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, এরই মধ্যে সীতাকুণ্ডে একজন, ঢাকায় র‍্যাবের ব্যারাকে হামলায় একজন, বিমানবন্দর সড়কে গোলচত্বরে বিস্ফোরণে একজন এবং সর্বশেষ সিলেটের আতিয়া মহলে নিহত চারজনের মধ্যে তিনজনসহ মোট ছয়জন আত্মঘাতী দলের সদস্য বলে নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সীতাকুণ্ড ও সিলেটে দুজন নারীও নিহত হয়। তবে তারা আত্মঘাতী দলের সদস্য কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ পর্যন্ত জঙ্গিদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে নারী সদস্যদের আক্রমণে ব্যবহার করার নজির পাওয়া যায়নি। এ দেশে শুরু থেকেই জঙ্গিরা নারী সদস্যদের মূলত সহায়তাকারী হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরীর মতে, আত্মঘাতী জঙ্গিরা সংখ্যায় খুব নগণ্য হলেও তারা যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এদের রিক্রুটমেন্ট বন্ধ করতে হবে। এ জন্য অনুকূল আর্থসামাজিক পরিবেশ আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এই ইস্যুতে একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’

জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি করছেন এমন একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, নতুন এই পর্বের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, নব্য জেএমবির একটা অংশকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এ কারণে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এখন দলটির নেতৃত্ব অপেক্ষাকৃত নতুন ও কম বয়সীদের হাতে চলে গেছে। ফলে তাদের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে এই কর্মকর্তারা বলেন, ৭ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনায় বাসে পুলিশের তল্লাশি দেখে দুই জঙ্গি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ফলে তারা ধরা পড়ে এবং তাদের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও সর্বশেষ সিলেটের আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। পরপর কয়েকটি ঘটনায় ছয়জন জঙ্গি আত্মঘাতী হলেও বাকিরা এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে রয়েছে।

গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে চলতি বছরের ২ মার্চ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৯ জন জঙ্গি নিহত হয়, যাদের মধ্যে তামিম চৌধুরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান, সারোয়ার জাহানের মতো নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তার মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে গত তিন সপ্তাহে নব্য জেএমবির যারা নিহত, আত্মঘাতী ও গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা সবাই হলি আর্টিজানে হামলার আগেই ‘হিজরতের’ নামে ঘর ছেড়েছিল। নতুন করে খুব বেশি সদস্য সংগ্রহ করতে পারেনি এই গোষ্ঠী। আগের লোকজনই নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে। তবে গুলশান হামলায় জড়িত নিবরাসদের যেভাবে সময় নিয়ে প্রশিক্ষিত করতে পেরেছে, এখনকার জঙ্গিদের সেভাবে তৈরি করতে পারেনি নব্য জেএমবি। ফলে তারা লক্ষ্যস্থলে আত্মঘাতী হামলা করতে গিয়ে মূলত নিজেরাই মারা পড়ছে।

এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো, হলি আর্টিজানে হামলার পরও জঙ্গিদের বিস্ফোরক সংগ্রহ এবং তা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আনা-নেওয়া এবং তাদের অর্থের উৎস বন্ধ করা যায়নি। বিস্ফোরক পরিবহন ও আর্থিক লেনদেনে তারা কুরিয়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করছে কি না, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার।

কুমিল্লা ও সীতাকুণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির এখনই আক্রমণে নামার পরিকল্পনা ছিল না। কয়েক মাস পর তারা বড় ঘটনা ঘটাত, সেই লক্ষ্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর তারা আগেভাগেই পাল্টা আক্রমণে চলে গেছে।

তবে গত শুক্রবার বিমানবন্দর সড়কে পুলিশ বক্সের কাছে বিস্ফোরণের ঘটনা হামলা ছিল না বলে দাবি এই কর্মকর্তার। তিনি বলেন, ওই জঙ্গি ট্রলিব্যাগে করে আরেক আস্তানায় বোমা নিয়ে যাচ্ছিল। ধরা পড়লে ফাটানোর জন্য পেটে বাঁধা ছিল একটি বোমা। সেটি বিস্ফোরিত হয়েছিল বোমার সুইচিং সিস্টেমে ত্রুটির কারণে।

একই সূত্র জানায়, নতুন এই পর্বে সিলেটে নিহত মঈনুল ওরফে মুসা গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও সে-ই দলের প্রধান নাকি অন্য কেউ, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মধ্যপ্রাচ্যফেরত দু-একজন এতে যুক্ত হয়েছেন, এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যফেরত ওই দু-একজন সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে আটক থাকা এক জঙ্গি। এটা এখনো যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে। এই কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, এখন জঙ্গিদের কাছে আত্মঘাতী হামলাকারী হিসেবে প্রস্তুত জঙ্গির সংখ্যা বড়জোর ১৫।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আরেকটি সূত্র বলছে, আত্মঘাতী হিসেবে এই পর্বে ৩০ জনকে তৈরি করেছে নব্য জেএমবি। যার কারণে সারা দেশে র‍্যাব ও পুলিশের সব স্থাপনা, বিমানবন্দরসহ স্পর্শকাতর সরকারি স্থাপনার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

সরকারের একটি সূত্র বলছে, সিরিয়া ও ইরাকে যেসব বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক যুদ্ধ করেছে, তারা দেশে ফেরে কি না, এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, ইরাক ও সিরিয়ায় এখন জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস কোণঠাসা। তাদের অনেক যোদ্ধা নিজ নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। আইএসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো জঙ্গি দেশে আসার সুযোগ পেলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে বিমানবন্দরসহ প্রতিটি জেলার পুলিশকে সতর্ক অবস্থায় থেকে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘জঙ্গি নির্মূলে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে আমরা অনেক আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে দু-একজন বের হয়ে গেছে। এরা নতুন কেউ নয়, সবই পুরোনো জঙ্গি।’

জানতে চাইলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান মো. ছানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রমে সাফল্য আসছিল। আমরা এখন প্রতিরোধমূলক কাজ করছি। যার ফলে জঙ্গিরা পাল্টা হামলায় নেমেছে।’ তিনি বলেন, আগে নব্য জেএমবি মূলত সীমান্তের ওপার থেকে কারখানায় তৈরি ডেটোনেটর, পাওয়ার জেলসহ বিস্ফোরক নিয়ে আসত। এই কাজে যুক্ত প্রায় সবাইকে ধরা হয়েছে। ফলে এখন জঙ্গিরা দেশীয় বাজার থেকে সচরাচর পাওয়া যায়, এমন রাসায়নিক, বিস্ফোরকসহ অন্যান্য উপাদান সংগ্রহ করছে। তাদের এখনকার বোমার ধরনও একটু ভিন্ন এবং অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের বোমা তৈরির কারিগরও নতুন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই কর্মকর্তার মতে, এই গোষ্ঠীর কাছে বিস্ফোরক (আইইডি) ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র নেই। তাই এই পর্বেও এদের নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে না।

তবে সংশ্লিষ্ট অন্য সূত্রগুলো বলছে, আগে গাইবান্ধা, বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিরা সংগঠিত ও প্রশিক্ষণ নিত এবং ঢাকা তাদের মূল লক্ষ্যস্থল ছিল। এখনো ঢাকা মূল লক্ষ্যস্থল হলেও নতুন করে সংগঠিত হওয়ার জন্য তারা উত্তরাঞ্চল বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলকে বেছে নিয়েছে। নোয়াখালী ও খুলনা অঞ্চলেও তারা আস্তানা গড়ে তুলেছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা দেশীয় হলেও তারা মূলত আইএসের মতাদর্শ অনুসরণ করে। তাদের মতোই আত্মঘাতী হামলাকে চূড়ান্ত কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ ছাড়া আইএসের নেটওয়ার্কের সঙ্গে এই নব্য জেএমবির কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ রয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। কারণ, সিরিয়া ও ইরাকে ইতিমধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশি আইএসের হয়ে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হয়েছে। আরও অনেকে সেখানে আছে, এমন খবর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বের হয়েছে। তাই এসব বাংলাদেশির মাধ্যমে দেশীয় জঙ্গিদের ইন্টারনেটে যোগাযোগ থাকার সুযোগ রয়েছে।

হলি আর্টিজানের হত্যাযজ্ঞ এবং তার আগে-পরে বেশ কিছু হামলার বিষয়ে আইএস যেভাবে দায় স্বীকার করেছে, সর্বশেষ ২৫ মার্চ সিলেটে আতিয়া মহলে অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায়ও তারা একইভাবে দায় স্বীকার করে। ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যার পর আইএস এ দেশে প্রথম কোনো ঘটনার দায় স্বীকার করে। এরপর গত দেড় বছরে মোট ৩১টি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। এসব ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৮৬ জন, যাদের মধ্যে ১০ জন জঙ্গি দলের সদস্য।

এই জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন করে সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো সাফকাত মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, আত্মঘাতী হওয়ার নতুন যে প্রবণতা, তা ভয়াবহ। এরা ঢাকার বাইরে অন্যান্য ছোট ও বড় শহরেও ছড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, নতুন করে নব্য জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সক্ষমতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। কোনোভাবে এই জঙ্গিদের হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই।