সাড়ে চার দশকের পথচলা

১৯৮০ সালের ২০ জুন। ১৭ হাজার নারীর স্বাক্ষর সংগ্রহ ও জনমত গঠন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যৌতুকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। সে সময় দেশে যৌতুক নিরোধ আইন হওয়ার পেছনে এ সংগঠনের আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৯৭০ সাল থেকে গত সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে মহিলা পরিষদ। আজ মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল সংগঠনটি ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করছে।
কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন এ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী। ১৯৯৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পরিষদের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে নারী মুক্তি আন্দোলন ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ শীর্ষক প্রকাশনার ভূমিকায় সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘মহিলা পরিষদের জন্মই সংগ্রামী জীবন নিয়ে। উনসত্তরের বিক্ষুব্ধ গণ-আন্দোলন থেকে শুরু করে মহিলা পরিষদ প্রত্যক্ষ আন্দোলনের সাথে জড়িত আছে।’
সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে মহিলা পরিষদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় যুক্ত হয়েছেন জাহানারা ইমাম, হেনা দাস, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, মনোরমা বসু, উমরতুল ফজল, সৈয়দা ফিরোজা বেগম, নূরজাহান মুরশিদ, চিত্রা ভট্টাচার্য, লায়লা সামাদ, বেলা নবীসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নারীরা।
আন্দোলন চলছেই
১৯৭২ সালে সরকারের কাছে উত্তরাধিকার আইন সংস্কার, সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য অবৈতনিক আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করার দাবি জানায় এ সংগঠন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও আন্দোলন পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। ১৯৮৫ সালে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নে সুপারিশ দেওয়া থেকে শুরু করে হাল আমলের বিভিন্ন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে পরিষদ।
আশির দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতিসংঘ সনদ ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)’-এর পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে।
মহিলা পরিষদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সরকার বিশেষ ধারা যুক্ত করে বাল্যবিবাহ নিরোধে যে আইন করল, তাকে নারী আন্দোলন সাধুবাদ জানাতে পারেনি। একই সঙ্গে সাইবার ক্রাইম, কর্মজীবী নারীর সমস্যাসহ নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তবে যেকোনো আইন বা নীতি প্রণয়নে সরকার মহিলা পরিষদের প্রতিনিধিদের ডাকছে, এটাই পরিষদের বড় শক্তি।
সংগঠনের যাত্রা শুরুর প্রস্তুতিপর্ব থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন বর্তমানে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মালেকা বেগম। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ, তারপর পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ এবং পরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামে কার্যক্রম শুরু করে। নারী মুক্তির ধ্যানধারণা এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসীরা যুক্ত হন পরিষদের সঙ্গে। শুরুর দিকে সংগঠকদের বাসায় সভা বসত। স্বেচ্ছাসেবীরা ডিম, মুরগি বিক্রি করে নিজের খরচ থেকে বাঁচানো টাকা সংগঠনের কাজে লাগাতেন। পরে ব্যক্তি সহায়তার মাধ্যমেই সেগুনবাগিচায় সংগঠনের নামে নিজস্ব বাড়ি তৈরি সম্ভব হয়।
কার্যক্রম
১৪টি আলাদা উপপরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সংগঠনের বহুমুখী কার্যক্রম। বর্তমানে ৭০টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের জোট সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সচিবালয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে মহিলা পরিষদ।
সংগঠনের বর্তমান সদস্যসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। প্রশিক্ষিত সংগঠক আছেন পাঁচ হাজার। ৬৩টি জেলা শাখার পাশাপাশি তৃণমূলে শাখা আছে দুই হাজারের বেশি।
সংগঠনের প্রথম দিকে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের বিভিন্ন সংগঠকের বাড়িতে রাখা হতো। ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে আশ্রয়কেন্দ্র রোকেয়া সদন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দাতা সংস্থার সহায়তা ছাড়া পরিচালিত হয় মহিলা পরিষদের কাজ।
মালেকা বানুর মতে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংগঠনের এখন দূরত্ব বেড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যেসব কৌশল নিচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই নারী অধিকারের বিপক্ষে যাচ্ছে। একশ্রেণির ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে শুধু সামরিক সরকার নয়, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সরকারও আপস করছে। পরিষদের লড়াই করার ক্ষেত্রে এগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।