রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে

দেশের প্রথম বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। দেশের পরমাণু কর্মসূচি ও রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের কাছ থেকে যেসব সহায়তা নেওয়া হবে, সেই খাতে এই ব্যয় বাড়বে। ভারতের প্রতিশ্রুত ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ (লাইন অব ক্রেডিট) থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গ টেলিভিশনকে উদ্ধৃত করে ভারতের অনলাইন পোর্টাল ‘লাইভমিন্ট’ এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাড়তি ব্যয় ৯৪ কোটি টাকা (৯৪০ মিলিয়ন) হতে পারে। আন্তর্জাতিক লেনদেন, ঋণ ও আর্থিক খাতের সংবাদ প্রকাশে মুনশিয়ানার জন্য ব্লুমবার্গ টেলিভিশনের খ্যাতি আছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, দেশের পরমাণু কর্মসূচি এবং রূপপুর প্রকল্পে ভারতের সহায়তার বিষয়ে কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তি (অ্যাগ্রিমেন্ট) হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে চুক্তি (কন্ট্রাক্ট) হবে। ভারতের কাছ থেকে রূপপুরের জন্য কী কী সহায়তা দরকার এবং তাতে ব্যয় কত হবে, তা সেই চুক্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। তাই ওই চুক্তিগুলো না হওয়া পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ বলা যায় না।
জানতে চাইলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সই হওয়া চুক্তিগুলোর (অ্যাগ্রিমেন্ট) আলোকে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে যেসব চুক্তি (কন্ট্রাক্ট) হবে, তাঁরা সেগুলো তৈরির কাজ শুরু করেছেন। এ ছাড়া আগামী সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণকাজ (ফার্স্ট কংক্রিট) শুরুর প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, ভারতের সহায়তায় রূপপুর প্রকল্পের যে বিষয়টি উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, তা হলো পারমাণবিক অবকাঠামো। দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচি এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে একটি স্থিতিশীল পারমাণবিক অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া ভারতের কাছ থেকে জনবল প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা নেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ১৯ দফা মাইলস্টোন গাইডলাইন উদ্ধৃত করে দেশের কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, নতুন কোনো দেশের জন্য ওই মাইলস্টোনের প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে—পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল কি আপনার আছে? এর উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে নির্মাণের উদ্যোগ স্থগিত করে আগে জনবল তৈরি করতে হবে।
ওই পরমাণুবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের অভিমত, সাধারণত যে দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচি রয়েছে এবং যারা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নেও হাত দিয়েছে, অবকাঠামো তৈরিতে পারদর্শী জনবল সেই দেশেরই থাকার কথা। বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের আগেই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে এই জনবল গড়ে তুলতে হয়। বাংলাদেশ অনেক বিলম্বে সেই কাজ শুরু করেছে। ফলে সব ব্যয় যুক্ত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্পের হিসাবে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় (৭-১০ এপ্রিল) সই হওয়া চুক্তি (অ্যাগ্রিমেন্ট) অনুযায়ী, ভারত সরকারের পরমাণু শক্তি বিভাগের অধীন গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) ইউনিট—গ্লোবাল সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি পার্টনারশিপ (জিসিএনইপি) এবং ভারতের ‘অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড (এইআরবি) এই সহায়তা দেবে। আর শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুই দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী এবং আইএইএর সাবেক পরিচালক ড. জসীমউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের সহায়তা নেওয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত। তাতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়বেই। তবে কথা হলো—পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো দেশের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প শুরুই করা হয়েছে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়া। কিছুটা তাড়াহুড়ো করে, অগোছালোভাবে। যাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে ভালো জানেন, তাঁদের পরামর্শ নেওয়া সরকারের উচিত ছিল। সেটা না করায় বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হবে। ব্যয়ও বাড়বে।
আইএইএর গাইডলাইনে পারমাণবিক অবকাঠামোকে বলা হয়েছে—একটি পারমাণবিক কর্মসূচি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগতভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অপরিহার্য বিষয়। আইএইএর অঙ্গ সংস্থা ‘ইন্টিগ্রেটেড নিউক্লিয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ (আইএনআইজি)’ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পারমাণবিক অবকাঠামোর বিষয়টি হালনাগাদ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, পারমাণবিক বিদ্যুতের জগতে নবাগত দেশগুলো যাতে নিরাপদ, সুরক্ষিত ও টেকসই পদ্ধতিতে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারে, সে জন্য অবকাঠামো অতি জরুরি (ক্রুশিয়াল) বিষয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পারমাণবিক অবকাঠামোর অনেক কিছু রাশিয়াই প্রকল্পের অংশ হিসেবে তৈরি করবে। ভারতের সহায়তা নেওয়া হবে এই খাতের জনবল প্রশিক্ষণ ও প্রকল্পবহির্ভূত কিছু বিষয়ে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (বিইআরএ) ক্ষমতায়ন, আইনগত ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি, সংকটকালীন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক, পারমাণবিক গোয়েন্দা সার্ভিস, সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রভৃতি রয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, অবকাঠামো তৈরি ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে ভারতের সক্ষমতা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সহযোগিতা নিলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। তা ছাড়া, ভারতও যেহেতু রাশিয়ার উদ্ভাবিত ভিভিইআর প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করছে, সেহেতু এই প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা, ব্যয় প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য আদান–প্রদান হলে বাংলাদেশ আরও বেশি উপকৃত হবে।
রূপপুর প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে আগে থেকেই কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। রাশিয়ার সঙ্গে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার। পরমাণু প্রকৌশলী আবদুল মতিন ভারতের কুদনকুলম বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছেন যে এটি অনেক বেশি হয়েছে।
রূপপুর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, এটি প্রকল্পের ‘ফার্ম অ্যান্ড ফিক্সড কস্ট’। এটা প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদে আর বাড়বে না। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একপর্যায়ে বলেছিলেন, এই প্রকল্পের অনেক ‘হিডেন কস্ট’ আছে। এখন সেটাই দৃশ্যমান হচ্ছে।