আমিন হুদা জেল খাটছেন হাসপাতালের বিছানায়!

আমিন হুদা
আমিন হুদা

‘কোমর ব্যথা’ নিয়ে ভর্তি হয়ে টানা ১৮ মাস হাসপাতালের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা। যদিও কারা কর্তৃপক্ষের কাগজপত্রে এই রোগীর ‘বুকে ব্যথা’র কথা বলা হয়েছে।

চিকিৎসাব্যয়ের বাইরে হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনের জন্য আমিন হুদা ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিল দিয়েছেন। তিনি মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত গাড়িচালককে নিয়ে ভ্রমণে বের হন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বারডেম হাসপাতালে কারাবন্দীদের রাখার নিয়ম নেই। কিন্তু মাসের পর মাস সেখানে থাকছেন সাজাপ্রাপ্ত ওই আসামি। শাস্তি হওয়ার পর এ পর্যন্ত কয়েকবার ‘হাজিরা’ দিতে দু-এক ঘণ্টার জন্য কারাগারে গেছেন তিনি। এবার টানা ১৮ মাস ধরে হাসপাতালে আছেন। হাসপাতালের, ৬, ৮, ৯ ও ১৫ তলার বিভিন্ন কক্ষে ঘুরেফিরে থাকছেন তিনি।

সাবেক কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) গোলাম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো বন্দীর চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা নির্ধারণ করবেন কারাগারের চিকিৎসক। কারাবিধি অনুযায়ী তিনিই সুপারিশ করবেন তাঁকে কোন হাসপাতালে পাঠানো দরকার। ১৮ মাস চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে থাকার বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর মতে, পুরো বিষয়টি সাজানো।

আমিন হুদাকে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর গুলশানের একটি বাড়ি থেকে ৩০ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গুলশানের আরেকটি বাসা থেকে ১৩৮ বোতল মদ, পাঁচ কেজি ইয়াবা বড়ি (সংখ্যায় ১ লাখ ৩০ হাজার) এবং ইয়াবা তৈরির যন্ত্র ও উপাদান উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের দুটি মামলায় তাঁর মোট ৭৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এরপর থেকে তিনি নামেই কারাগারে আছেন।

সাজাপ্রাপ্ত আসামির এভাবে মাসের পর মাস হাসপাতালে অবস্থান করা নিয়ে বারডেম হাসপাতাল ও কারা প্রশাসন একে অপরকে দোষারোপ করেছে।

বারডেম হাসপাতালের অষ্টম তলার ৮০১ নম্বর কক্ষে আছেন আমিন হুদা। গত বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি দুটি কক্ষের একটিতে চারজন পুলিশ, দুজন কারারক্ষী, গাড়িচালক ও তাঁর ব্যক্তিগত কর্মী বসে গল্প করছেন। নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত কর্মীদের কেউ কেউ মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত। একজন জানতে চাইলেন, ‘কোথা থেকে এসেছেন?’ আরেকজন জিজ্ঞেস করেন, ‘বস কি আপনাকে আসতে বলেছেন?’ তৃতীয় আরেকজন বললেন, ‘ভেতরে যান, বস ঘুমাচ্ছেন।’

কক্ষের ভেতরে যেতেই দেখা গেল আমিন হুদা নিজেও মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে টেলিভিশন, ফ্রিজ, মুঠোফোন, ল্যাপটপসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেখা যায়। প্রতিবেদককে দেখে রেগে গিয়ে তিনি বললেন, ‘এখন ঘুমাচ্ছি, বিরক্ত করবেন না।’ এরই মধ্য তাঁর ব্যক্তিগত কর্মী প্রতিবেদককে নিয়ে পাশের কক্ষে যান। তখনো পুলিশ ও কারারক্ষীরা মুঠোফোন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। বিকেলে হাতকড়া ছাড়াই হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটছিলেন আমিন হুদা। সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ও নিরাপত্তাকর্মীদের দেখা যায়।

আমিন হুদার গাড়িচালক কেন দরকার জানতে চাইলে চালক কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলেন, তিনবেলা স্যারের খাবার আনা-নেওয়া করতে হয়। এ ছাড়া তিনি মাঝেমধ্যে বাইরে যান। পরক্ষণেই আবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন, তবে এখন আর বের হন না।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর সাধারণ বন্দী হিসেবে আমিন হুদা হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর চিকিৎসা করছেন হাসপাতালের হৃদ্‌রোগ বিভাগের প্রধান এ কে এম মহিবুল্লাহ। রোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর কয়েকটি রোগ আছে, তবে তিনি এখন সুস্থ। এত দিন হাসপাতালে রাখার কারণ জানতে চাইলে চিকিৎসক বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তাঁকে হাসপাতাল থেকে নেওয়ার পরদিনই চলে আসেন। একদিন তো দুপুরে নিয়ে আবার রাতে ফিরিয়ে এনেছেন।’

বারডেমের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যেখানে প্রিজন সেল আছে, সেখানেই ওই আসামিকে নিয়ে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু কারাগার প্রশাসন তাঁকে নিচ্ছেন না। তিনি বলেন, সকালে ছুটি দিলে রাতেই আবার ব্যথা বলে চিৎকার করে হাসপাতালে ভর্তি হন ওই রোগী।

আমিন হুদা সুস্থ কি না, জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বারবার চিঠি দিয়ে আমিন হুদাকে ফেরত পাঠাতে বলেছি, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফেরত পাঠাচ্ছে না।’

বারডেমে পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে ওই চিকিৎসক বলেন, ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশেই তাঁকে বারডেমে পাঠানো হয়েছে। তাঁরাই ঠিক করে দেন কে, কোন হাসপাতালে যাবে। আমি শুধু তাঁদের রোগের কথা জানাই।

হাসপাতাল ও কারাগারের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আমিন হুদা ভিআইপি বা ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামি না হলেও প্রভাব খাটানোসহ বিভিন্ন উপায়ে বারডেমে মাসের পর মাস থাকছেন। প্রায় সাত বছর ধরে তিনি বারডেমে আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছেন। এর আগে অ্যাপোলো, ইব্রাহিম কার্ডিয়াকসহ বড় বড় হাসপাতালে কাটিয়েছেন তিনি। তাঁর কাছে সব সময় দর্শনার্থী, ব্যবসায়ী, বন্ধু ও স্বজনেরা আসা-যাওয়া করছেন। এ জন্য কারও অনুমিত নিতে হয় না।

এদিকে বারডেম কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তারা কয়েক দফায় চিঠি দিয়ে এই হাসপাতালে কোনো আসামি না পাঠানোর অনুরোধ করেছে। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছুদিন আগেও কারা কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি দিয়ে বলেছি, বারডেম হাসপাতালে যেন কোনো রোগী না পাঠায়। কিন্তু তারা পাঠাচ্ছে। কারাবন্দীদের চিকিৎসার জন্য পাঠানোর কারণে আমাদের সাংঘাতিক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। কিন্তু রোগী পাঠালে কীই-বা করার থাকে?’