একমাত্র ভরসা বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্র

পাবনার বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের মূল ভবন  l ছবি: প্রথম আলো
পাবনার বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের মূল ভবন l ছবি: প্রথম আলো

নিয়মিত অনুষ্ঠান করার মতো মিলনায়তনের অভাববোধ করছেন পাবনার সাংস্কৃতিক কর্মীরা। জেলা শিল্পকলা একাডেমির কোনো মিলনায়তন নেই। অনুষ্ঠান করার মতো একমাত্র মিলনায়তন শহরের প্রাণকেন্দ্র আবদুল হামিদ সড়কের বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্র। আর রয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। এর ওপর নির্ভর করেই চলছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম।

বহুকাল থেকেই পাবনা সাংস্কৃতিক চর্চায় যথেষ্ট অগ্রসর। শহরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে নাটক, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তির চর্চা করে এবং প্রশিক্ষণ দেয়, এমন সক্রিয় সংগঠনের সংখ্যা ৩০-এর বেশি। নাটকে পাবনার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। এখন নিয়মিত নাট্যচর্চা করে পাবনা ড্রামা সার্কেল, থিয়েটার-৭৭, অনুশীলন-৮০, দর্পণ শিল্পীগোষ্ঠী ও গণমঞ্চ।

সংগীত ও নৃত্য সংগঠনের মধ্যে সক্রিয় তাল-লয় শিল্পীগোষ্ঠী, অনিন্দ্য, গণশিল্পী, উদীচী, ললিত কলা কেন্দ্র ইফা, আফা ইনস্টিটিউট, সুরের মেলা, গন্তব্য, সোনার বাংলা মা একাডেমি, নৃত্যাঞ্চল পাবনা, রবীন্দ্র ও নজরুল পারিষদ, লালন পরিষদ, সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বাচন শৈলী ইত্যাদি। এ ছাড়া তরুণ প্রজন্মের গাইয়েরা বেশ কয়েকটি ব্যান্ডও গড়ে তুলেছেন। এর মধ্যে বিহঙ্গ, বৈঠক, অ্যাড্রেস ও বিভব বেশ জনপ্রিয়।

মিলনায়তন মাত্র একটিই বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্র। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত এই প্রতিষ্ঠানটি সাংস্কৃতিক চর্চাকে উৎসাহিত করতে মিলনায়তনের সুবিধাসহ নগদ আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত মিলনায়তন না থাকায় সাংস্কৃতিক চর্চায় যথেষ্ট বেগবান হচ্ছে না।

‘বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মুক্তমঞ্চ’টি অপরিসর। মঞ্চ-সংলগ্ন ভবনে শিল্পীরা সাজসজ্জা করতেন। জরাজীর্ণ ওই ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। পৌরসভার খোলা মাঠের এই মঞ্চেই পাবনার অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের অনুষ্ঠান করে। এখানে গান বা নাচের অনুষ্ঠান করা গেলেও, মঞ্চটি নাটকের অনুপযোগী।

এদিকে সাংস্কৃতিক কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সম্প্রতি কাচারিপাড়ায় শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন নির্মাণ শুরু হলেও অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে আছে।

পাবনার জমিদার রায়বাহাদুর বনমালী রায়ের দুই ছেলে ক্ষীতিশ রায় ও রাধিকা রায় সাংস্কৃতিক চর্চার প্রসার ও প্রেরণা দিতে ১৯২৪ সালে তাঁদের বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেন বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্র। তখন এর নাম ছিল বনমালী রঙ্গমঞ্চ। পরে করা হয় বনমালী ইনস্টিটিউট। জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এটি। ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী হলে সরকারি উদ্যোগে ২০০৯ সালে মিলনায়তনটির সংস্কার শুরু হয়। তখন এটিকে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও সুধীজনেরা বারোয়ারি কাজের মিলনায়তনের বদলে নিজেদের অর্থায়নে এটিকে শুধুই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপযোগী একটি আধুনিক মিলনায়তন হিসেবে গড়ে তোলেন। নতুন করে এর নামকরণ করা হয় ‘বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্র’। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত কমিটির মাধ্যমে। ত্রিবার্ষিক এই কমিটির সভাপতি স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল হান্নান।

বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে আসনসংখ্যা ৭৫৯। পুরুষ ও নারী শিল্পীদের জন্য রয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পৃথক প্রসাধনী কক্ষ। তিনটি মহড়া কক্ষ, একটি মতবিনিময় কক্ষ, অফিস কক্ষ ছাড়াও রয়েছে একটি সুপরিসর খেলার জায়গা, যেখানে প্রয়োজনে কর্মশালা বা নিরীক্ষাধর্মী যেকোনো অনুষ্ঠানও করা যেতে পারে।

নতুন আঙ্গিকে এর কার্যক্রমেও বেশ অভিনবত্ব আনা হয়েছে। আবদুল হান্নান বলেন, এখানে অনুষ্ঠান করার জন্য মিলনায়তনের ভাড়া দিতে হয় না। বরং সংগঠনগুলোকে প্রণোদনা হিসেবে নগদ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। নাটকের দল পায় ৪৫ হাজার টাকা, নৃত্য সংগঠন ২৫ হাজার এবং সংগীত ও আবৃত্তি সংগঠনগুলো পায় ২০ হাজার টাকা। উপরন্তু অনুষ্ঠানের আগে চার দিন স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, মাইকিং, বিলবোর্ড স্থাপন, মিলনায়তনের সাজসজ্জা, প্লে-বিল ছাপা, মঞ্চ ব্যবস্থাপনা এসব করে দেওয়া হয়। বনমালীর সব অনুষ্ঠানই হয় দর্শনীর বিনিময়ে। টিকিট ৫০ টাকা। টিকিট বিক্রির দায়িত্বও বনমালীর। এসব খরচ আসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পনসরে। স্পনসরও বনমালীই জোগাড় করে।

প্রতি মাসেই একাধিক অনুষ্ঠান হয় বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রে। পাবনার অধিকাংশ প্রধান সংগঠনই এখানে অনুষ্ঠান করেছে। এর বাইরে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়ার বিভিন্ন দল এখানে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে।

নতুন আঙ্গিকের বনমালীর ভূমিকা স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা মূলত উৎসাহিত। তবে ভিন্নমতও আছে। ড্রামা সার্কেলের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে এখানে কাজ করতে পারতেন। নতুন ব্যবস্থাপনায় শিল্পীদের সেই স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

গণমঞ্চের সম্পাদক স্বাধীন মজুমদার বলেন, মফস্বল শহরগুলোতে নাটক বা কোনো অনুষ্ঠান করতে টাকার ব্যবস্থা করা একটি বড় সমস্যা। বনমালীর নতুন ব্যবস্থাপনায় সেই সমস্যা অনেকটা কেটেছে। তা ছাড়া প্রচার ও আনুষঙ্গিক আয়োজনের বাড়তি ঝামেলাও নিতে হচ্ছে না।

আফা ইনস্টিটিউটের পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, বনমালীতে অনুষ্ঠান করার জন্য এখন সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনুষ্ঠানের মানও ক্রমান্বয়ে ভালো হচ্ছে। তবে মিলনায়তন একটিই, তাই স্থানীয় দলগুলোকে বেশি করে সুযোগ দেওয়া উচিত।