৪৯ সদস্যের মন্ত্রিসভায় নতুন ২৮

গতকাল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শপথ পাঠ করান । ছবি: বাসস
গতকাল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শপথ পাঠ করান । ছবি: বাসস

অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের নিয়ে নতুন সরকার গঠন করলেন শেখ হাসিনা। পুরোনো মন্ত্রিসভার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্য এবার বাদ পড়েছেন। বিশেষ করে যেসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ গত পাঁচ বছরে অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়েছেন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন, তাঁদের নেওয়া হয়নি।
বিরোধী দলহীন একতরফা নির্বাচনের এক সপ্তাহের মধ্যে গতকাল রোববার নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে। বিরোধী জোটের প্রতিরোধের মধ্যেই টানা দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হলো। শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ অনুষ্ঠানে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, তিন বাহিনীর প্রধানের, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনসহ বিদেশি কূটনীতিক ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
৪৯ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টির এক মন্ত্রী ও দুই প্রতিমন্ত্রী, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জাতীয় পার্টি জেপির একজন করে মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। এ মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি থাকায় কার্যত সংসদে বিরোধী দল থাকল না।
পুরোনো মন্ত্রিসভার ৫১ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৫ জন এবার স্থান পেয়েছেন। বাকিরা বাদ পড়েছেন। নতুন মুখ যুক্ত হয়েছেন ২৮ জন। নতুন সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ২৯ জন মন্ত্রী, ১৭ প্রতিমন্ত্রী এবং দুজন উপমন্ত্রী রয়েছেন। এ ছাড়া এইচ এম এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং চারজনকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁরা মন্ত্রীর পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি ভোগ করবেন।
মন্ত্রীদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, হাসানুল হক ইনু, ওবায়দুল কাদের, মুজিবুল হক, খন্দকার মোশাররফ হোসেন আগের মন্ত্রণালয়েই বহাল আছেন।
নতুন মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন।
চার উপদেষ্টা: প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে চারজনকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, আন্তর্জাতিক-বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও নিরাপত্তা-বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহেমদ সিদ্দিক। এঁরা আগেও উপদেষ্টা ছিলেন। তবে পুরোনো উপদেষ্টাদের মধ্যে তিনজন বাদ পড়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া: শপথের পর এক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে জাতীয় ঐকমত্য ও সমঝোতা সৃষ্টি হোক, এটা আমরা চাই। ঐকমত্যের সরকার নতুন নয়। ’৯৬ সালেও বিরোধী দলকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার করেছিলাম।’ নতুন সরকারের মূল লক্ষ্য হিসেবে দেশের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুল করেছেন, তা তিনি এখন উপলব্ধি করছেন। যারাই তাঁকে এ পরামর্শ দিক, তা যে ভুল এটা তিনি উপলব্ধি করছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিএনপি চেয়ারপারসন গণতন্ত্রের পথে না এসে সংঘাত ও নাশকতা বেছে নিলেন। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু বিএনপি এলে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হতো। গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হতো।
নতুন মন্ত্রিসভায় জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকেরা স্থান পেলেও কয়েকজন নানা কারণে বিতর্কিত। লতিফ সিদ্দিকী পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে নিয়ম ভঙ্গ করে বিজেসির অন্তত ৩০ কোটি টাকার সম্পদ মাত্র তিন কোটি টাকায় দুই ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেন। ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের আলমগীর মনসুর মিন্টু কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন দখলসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম আইন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্পে যৌথভাবে কয়েকটি যৌথ প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজটি করতে না পারায় পুরো প্রকল্পটি এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শপথ অনুষ্ঠান: বেলা তিনটা থেকেই দরবার হলে শপথ নেওয়ার জন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা পৌঁছাতে থাকেন। তিনটা ২৪ মিনিটে এইচ এম এরশাদ দরবার হলে পৌঁছালে সবাই করতালি দেন। এরশাদ তখন সবার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তিনটা ২৯ মিনিটে শেখ হাসিনা দরবার হলে আসেন। এর মিনিটখানেক পরই রাষ্ট্রপতি আসেন। পবিত্র কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এরপর পর্যায়ক্রমে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা শপথ নেন এবং শপথ বইয়ে সই করেন। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বিকেল চারটায় শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও দপ্তর
মন্ত্রী যাঁরা: আবুল মাল আবদুল মুহিত (অর্থ মন্ত্রণালয়), আমির হোসেন আমু (শিল্প), তোফায়েল আহমেদ (বাণিজ্য), মতিয়া চৌধুরী (কৃষি), আবদুল লতিফ সিদ্দিকী (ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), মোহাম্মদ নাসিম (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ), সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়), খন্দকার মোশাররফ হোসেন (প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান), রাশেদ খান মেনন (বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন), মতিউর রহমান (ধর্ম), মোশাররফ হোসেন (গৃহায়ন ও গণপূর্ত), আ ক ম মোজাম্মেল হক (মুক্তিযুদ্ধ), মো. সায়েদুল হক (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ), ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক (বস্ত্র ও পাট), ওবায়দুল কাদের (যোগাযোগ), হাসানুল হক ইনু (তথ্য), আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (পানি সম্পদ), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (পরিবেশ ও বন), নুরুল ইসলাম নাহিদ (শিক্ষা), শাজাহান খান (নৌপরিবহন), আনিসুল হক (আইন), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (দুর্যোগ ও ত্রাণ), মুজিবুল হক (রেলপথ), আ হ ম মুস্তফা কামাল (পরিকল্পনা), মোস্তাফিজুর রহমান (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা), আসাদুজ্জামান নূর (সংস্কৃতি), সৈয়দ মহসিন আলী (সমাজ কল্যাণ), শামসুর রহমান শরীফ (ভূমি) ও কামরুল ইসলাম (খাদ্য)।
প্রতিমন্ত্রী: মুজিবুল হক (শ্রম ও কর্মসংস্থান), ইয়াফেস ওসমান (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি), এম এ মান্নান (অর্থ), মির্জা আজম (বস্ত্র ও পাট), প্রমোদ মানকিন (সমাজ কল্যাণ), বীর বাহাদুর উ শৈ সিং (পার্বত্য চট্টগ্রাম), নারায়ণ চন্দ্র চন্দ (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ), বীরেন শিকদার (যুব ও ক্রীড়া), আসাদুজ্জামান খান কামাল (স্বরাষ্ট্র), সাইফুজ্জামান চৌধুরী (ভূমি), ইসমাত আরা সাদেক (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা), মেহের আফরোজ (মহিলা ও শিশু), জাপার মসিউর রহমান (রাঙ্গা) (পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ), শাহরিয়ার আলম (পররাষ্ট্র), জাহিদ মালেক (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ), নসরুল হামিদ (বিদ্যুৎ) ও জুনাইদ আহমেদ (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি)।
উপমন্ত্রী: আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব (পানিসম্পদ) ও আরিফ খান জয় (যুব ও ক্রীড়া)।

বঙ্গভবনে গতকাল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন সরকারের মন্ত্রীদের শপথ পাঠ করান । ছবি: বাসস
বঙ্গভবনে গতকাল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন সরকারের মন্ত্রীদের শপথ পাঠ করান । ছবি: বাসস