তরুণদের চাওয়া নিয়ে কেউ ভাবেনি

‘জঙ্গিবাদের সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগে তরুণেরা কী চায়, তা কেউ ভাবেনি’। প্রথম আলো ফাইল ছবি
‘জঙ্গিবাদের সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগে তরুণেরা কী চায়, তা কেউ ভাবেনি’। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বেসরকারি একটি ব্যাংকের শিক্ষানবিশ আফিয়া হককে জঙ্গিবাদ নিয়ে তরুণদের ভাবনা সম্পর্কে বলতেই ক্ষোভ ঝাড়লেন। জঙ্গিবাদের সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগে তরুণেরা কী চায়, তা কেউ ভাবেনি। তাদের প্রয়োজনটাকে পাত্তা দেওয়া হয়নি বলে মনে করছেন এই তরুণী।
আফিয়া হক বলেন, ‘আদর্শের কথা বলবেন, ফেসবুক-টিভি খুললে কিছু মুখ দেখা যায়। নিজেদের বেশ কিছু ফলোয়ার বানিয়েছেন। মোটিভেশনাল স্পিচ দেন। কিন্তু যদি তাঁদেরকে এই তরুণদের জন্যই মাঠে নামতে বলেন, তা নামবেন না। গা বাঁচিয়ে চলে এঁরা।’
কর্মজীবনে ঢুকতে যাওয়া এই তরুণী এখন কাউকে আদর্শ হিসেবে খুঁজে পান না। তরুণদের চাওয়াকে কেউ আগে গুরুত্ব দেয়নি। এখনো যা হচ্ছে, এটাকে লোক দেখানো বললেন তিনি।
তরুণদের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চ মাসে সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণের ওপর জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদসহ অন্যান্য বিষয়ে তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়।
জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ শতাংশের মতে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা এবং অপব্যবহার করেও তরুণদের একটি অংশকে জঙ্গিবাদে আনা হচ্ছে। আবার বেকারত্ব ও দারিদ্র্য তরুণদের জঙ্গিবাদের পথে টেনে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করে ৭২ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়া ৪৯ শতাংশ তরুণের ধারণা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ও অশিক্ষার মতো বিষয়গুলো জঙ্গিবাদ উসকে দিতে প্রভাবকের ভূমিকা রাখছে।
জরিপের এ ফলাফল নিয়েই কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ঢাকা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম দারিদ্র্যকে জঙ্গিবাদের বড় কারণ মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘যেসব জঙ্গি ও তাদের নেতা সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি, বেশির ভাগই পয়সাওয়ালাদের ছেলেপুলে। গরিব ঘরের সন্তানদের বীর হওয়ার চিন্তা থাকে না। অ্যাডভেঞ্চারে যায় বড়লোকের সন্তানেরাই।’ তিনি সামাজিক মূল্যবোধ ও সন্তানের প্রতি মা-বাবার অনুশাসনের অভাবকে বড় কারণ মনে করেন। একই কলেজের আরেক শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান বেকারত্বকে জঙ্গিবাদের বড় কোনো কারণ মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শুনিনি চাকরির হতাশা থেকে কেউ জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে।’
ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতাকে জঙ্গিবাদ উত্থানের বড় কারণকে সমর্থন করেন অনেক তরুণ। আবার অনেকে সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়ার কেউ নেই বলেও ভাবছেন। নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ বলেন, ‘ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা বলি আমরা, তাহলে সঠিক ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারছে? মসজিদ বা ওয়াজে আমরা যা শুনি, তা-ই বিশ্বাস করি। আসলে সেখানে কতটুকু সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, সেটা কেউ যাচাই করতে যায় না।’ জালাল বলেন, মসজিদের ইমাম বা খতিব নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা যাচাই করে নিয়োগ দেওয়া উচিত। তিনি এখানে সরকারের নজরদারির কথা বলেন।
জঙ্গিবাদ দমনে তরুণেরা পরিবারের ভূমিকাকে বড় মনে করছেন। তাঁরা মা-বাবার কাছ থেকে সময় চান। তুরিবা আক্তার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়ছেন। সন্তানের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ যেমন দরকার, তেমনি অনুশাসনটাও দরকার। তিনি বলেন, ‘একটু বড় হয়ে গেলেই মডার্ন ফ্যামিলিতে সন্তানের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীনতা দেখা যায়। ছেড়ে দেয়, কিন্তু এ সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা দেবে, কিন্তু কী করছি, কাদের সঙ্গে মিশছি—সবই তাঁদের খেয়াল রাখা উচিত।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন না করে পড়ানোর ফাঁকে শিক্ষকদের এসব বিষয় নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করার জন্য বলেন তরুণেরা। এতে শিক্ষার্থীদের মত সম্পর্কে জানা যায়। জঙ্গিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও তৎপরতা আশা করেন তাঁরা।