আট জেলায় নতুন করে বন্যা

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদ-নদীর পানি বেড়ে গেছে। ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল শহরের কলেজ সড়ক এলাকায় টাঙ্গন নদের পানিতে ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি l প্রথম আলো
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদ-নদীর পানি বেড়ে গেছে। ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল শহরের কলেজ সড়ক এলাকায় টাঙ্গন নদের পানিতে ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি l প্রথম আলো

কয়েক দিন ধরে টানা বর্ষণ ও ঢলে দেশের উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের অন্তত আটটি জেলায় নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। প্রধানত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জেলাগুলোতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় অনেকে উঁচু স্থান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। পানি ঢোকায় সুনামগঞ্জে এক হাজারের বেশি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ব্যাহত হচ্ছে পরীক্ষা ও পাঠদান কার্যক্রম।

এদিকে নেত্রকোনায় তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। জেলার দুর্গাপুরে ৩০টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। হবিগঞ্জে খোয়াই নদের পানি গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপৎসীমার ১৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে হবিগঞ্জ শহরবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরাত দিয়ে প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

সুনামগঞ্জে নদ-নদী ও হাওরে পানি বাড়ায় সুনামগঞ্জ সদর, দোয়ারাবাজার, দিরাই, ধরমপাশা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। সড়ক প্লাবিত হওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার সরাসরি যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. বায়েজিদ খান জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। কিন্তু ঢল ও প্রবল বর্ষণে অনেক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে।

জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির শুক্রবারের জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, ধরমপাশা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও দিরাইয়ের ৮৯৩ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গতকাল পরীক্ষা হয়নি। আজ রোববারের পরীক্ষাও স্থগিত থাকবে। এদিকে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন জানান, গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। তাই গতকাল থেকে দুই দিনের জন্য ২৮৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশ্বম্ভরপুরের শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সুরমার তীর উপচে সুনামগঞ্জ শহরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি বেড়ে তা উপচে পড়ে জেলায় আবার বন্যা দেখা দিয়েছে। নগরে সুরমার নদীতীরবর্তী এলাকা, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার থেকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এ দুই উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়া ছাড়াও সড়কে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমেছে।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সদর বাজারে গতকাল বিকেলে ছিল হাঁটুপানি l প্রথম আলো
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সদর বাজারে গতকাল বিকেলে ছিল হাঁটুপানি l প্রথম আলো

ভারী বর্ষণ ও ঢলে পঞ্চগড় শহর ছাড়াও পাঁচ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলার সব নদীর পানি বেড়েছে। জেলা শহরসহ বেশ কিছু এলাকার বন্যাকবলিত মানুষ স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সংকটে লোকজন মানবেতর জীবন যাপন করছে।

লালমনিরহাটে চার দিন ধরে বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তাসহ সব নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে পাটগ্রাম, হাতীবান্ধাসহ পাঁচটি উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে সদ্য রোপণ করা কয়েক হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের খেত।

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলাসহ প্রধান নদ-নদীর পানি বেড়ে চার শতাধিক চর-দ্বীপচর ও নদীতীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ২০ হাজার মানুষ। এদিকে পানি বাড়ায় বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন তীব্র হয়েছে। ভূরুঙ্গামারীতে ৪০টি গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

দুই দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজানের ঢলে নীলফামারী জেলায় তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদীর পানি। হাঁটু ও কোমরসমান পানি উঠেছে নীলফামারী পৌর শহরসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে। ডুবে আছে রাস্তাঘাট। তলিয়ে আছে জেলার প্রায় আট হাজার হেক্টর ফসলি জমি।

সুরমা নদীর তীর উপচে ঢলের পানি ঢুকে পড়ছে সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর এলাকায়। ছবিটি গতকাল বেলা ১১টায় তোলা l প্রথম আলো
সুরমা নদীর তীর উপচে ঢলের পানি ঢুকে পড়ছে সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর এলাকায়। ছবিটি গতকাল বেলা ১১টায় তোলা l প্রথম আলো

নীলফামারী পৌরসভার প্যানেল মেয়র ঈসা আলী বলেন, ভারী বৃষ্টির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, বৃষ্টি কমলে পানি নেমে যাবে। তিনি বলেন, গোটা পৌরসভার কয়েকটি মহল্লার চার থেকে পাঁচ শ পরিবারের বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক গোলাম মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, এ অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

টানা বর্ষণে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া টাঙ্গন, বগরাডারা, কাহানাই, লাছি, চরনা ও রামডারা এবং দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলা তুলাই, রাক্ষসনী ও টাঙ্গন নদ-নদীর পানির তোড়ে ১১টি ইউনিয়নের অন্তত ১৪টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু করে গতকাল দিনভর টানা বর্ষণে খাল-বিল ও নদী ভরে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে এ বন্যা।

জনপ্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, পীরগঞ্জের জনগাঁও, কাচনা ও কুশারীগাঁও বিলের প্রায় ২ হাজার ও ঘিডোবের ৭০০ একরের রোপা আমন পানিতে ডুবে আছে। বিলকাচনা, তরলা, খামার সেনুয়াসহ সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জিয়াউল ইসলাম এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও পীরগঞ্জের ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) মো. সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, ‘আশ্রয় নেওয়া মানুষের কাছে গিয়ে চিড়া, গুড় ও মোমবাতি দেওয়া শুরু করেছি। পরে আরও উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।’

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীতে ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দ্রুত পানি বৃদ্ধির ফলে নদীতীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে নদীতীরবর্তী অনেক নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট; কুড়িগ্রাম সুনামগঞ্জ অফিস, নীলাফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনাহবিগঞ্জ প্রতিনিধি)