'এবার একসঙ্গে ঈদ করব, মা'
ছয় বছর আগে ঢাকার একটি ওষুধ কোম্পানিতে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন রেজাউল করিম। একসময় তাঁর শরীর দুর্বল লাগতে শুরু করে। তখন একদিন চিকিৎসকের কাছে গেলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক বলে দিলেন, তাঁর এক কিডনিতে সমস্যা। এরপর ওষুধ খেতে লাগলেন। চাকরিও করতে থাকলেন। এভাবে চার বছর কেটে যায়। বছর দু-এক আগে তাঁর শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। চোখে দেখেন ঝাপসা। চিকিৎসক একদিন বলে দিলেন, দুটি কিডনিতে বড় সমস্যা। এরপর জমি বিক্রি করে গেলেন ভারতে। সেখান থেকে বলা হলো, কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় নেই। একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে মা রোকেয়া বেগম তাঁর নিজের কিডনি দিতে চাইলেন। ঢাকায় ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে থাকা শুরু করলেন। এভাবে হাসপাতালে কাটে তাঁদের গত রোজার ঈদ। তখন রেজাউলের ছোট্ট মেয়ে বন্যা মুঠোফোনে বলেছিল, ‘বাবা তুমি বাড়ি আসবে না?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, সুস্থ হয়ে আমি কোরবানির ঈদে বাড়ি আসব।’ মেয়েকে দেওয়া কথা রাখতে অসুস্থ শরীর নিয়েও আজ সোমবার সকালে তাঁরা হাজির হন কমলাপুর রেলস্টেশনে। বাড়ি ফেরার জন্য তাঁদের অপেক্ষা। রেজাউল আর রোকেয়া জানালেন এসব কথা।
রেজাউলের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সাদাই গ্রামে। বাবার নাম খোদাবক্স প্রামাণিক। তাঁর পাঁচ বোন আছে। ১২ বছর আগে বিয়ে করেন রেজাউল। তাঁর তিন সন্তান। বড় ছেলের নাম সাগর (১০), মেয়ে বন্যা খাতুন (৬) এবং ছোট ছেলে মোহাম্মদ (৭ মাস)। তাঁর বড় ছেলে স্থানীয় একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে বন্যাও স্কুলে যায়। স্ত্রী ফুয়ারা খাতুন গ্রামে থাকেন।
চাকরি করে ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার। এরপরই অসুখ এসে বাসা বাঁধল শরীরে। মেয়ে বন্যার কথা সব সময় কানে বাজে রেজাউলের। মেয়ের সঙ্গে প্রতিদিন কয়েকবার মুঠোফোনে কথা বলেন। তার সঙ্গে দেখা হয়নি চার মাস।
রেজাউল জানালেন, শরীর এখন এতটাই দুর্বল যে একা একা হাঁটতে পারেন না। তাই মা সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকেন। সপ্তাহে দুবার কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়। ওষুধ আর ডায়ালাইসিস মিলিয়ে এখন প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। ছয় বছরে খরচ হয়ে গেছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। রেজাউলের মা রোকেয়া বললেন, ‘ডায়ালাইসিস না করলে উঠতেই পারে না। তখন ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি না।’
একপর্যায়ে রোকেয়া নিজের কিডনি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে নেন অনুমতি। ঢাকায় হাসপাতালে অনেক টাকা খরচ করে পরীক্ষা করান। কয়েক দিন আগে চিকিৎসক বলে দেন, তাঁর ডায়াবেটিস। তাই কোনোভাবে তিনি কিডনি দিতে পারবেন না। এসব কথা বলার সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন রোকেয়া। তিনি বলছিলেন, ‘রেজাউলের তিনটি ছেলেমেয়ে। ওদের মুখের দিকে তাকালে বুক ভেঙে আসে। কীভাবে ছেলেকে বাঁচাব? জানি না, কপালে কী আছে? রোজার ঈদে কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। এবার বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কপালে যে কী আছে বলতে পারব না।’
রোকেয়া যখন কমলাপুর রেলস্টেশনে কথা বলছিলেন, তখন রেজাউলের মুঠোফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরতেই মেয়ে বন্যা বলে ওঠে, ‘বাবা, তুমি এখন কোথায়?’ জবাবে রেজাউল বলেন, ‘আমরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। এবার একসঙ্গেই আমরা ঈদ করব, মা।’