'দুই মাস ধরি পানির ওপর ভাসরাম'

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের উলুয়াইল বাজারে পাকা সড়কের ওপর নৌকা চলছে। ছবিটি গত শনিবার বিকেলে তোলা l প্রথম আলো
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের উলুয়াইল বাজারে পাকা সড়কের ওপর নৌকা চলছে। ছবিটি গত শনিবার বিকেলে তোলা l প্রথম আলো

ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। বাঁশের মাচা বেঁধে তার ওপর থাকা, ঘুমানো, রান্নাবান্না—সবকিছুই। এ রকম একটি ঘরে বসবাসকারী বাণী রানি বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাস ধরি পানির ওপর ভাসরাম। হুকনা (শুকনো) মাটি ছইতাম (ছুঁতে) পারছি না। কোনোবায় (কোনো দিকে) যাইবার উপায় নাই। খানিবনি (খাওয়া-দাওয়া) সবমনতে (সবকিছুতেই) কষ্ট কররাম। রাইত অইলে হাপর ডর (সাপের ভয়)। নাও-ও নাই। বাইরইলে পানি ভাঙি যাওয়া লাগে।’

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউয়াদিঘি হাওরপারের বড়বাড়ি এলাকায় এখন এ রকমভাবেই অনেক বাড়ির লোকজন বসবাস করছে। প্রায় দুই মাস ধরে এই অবস্থা চলছে।

সম্প্রতি বড়বাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একেকটি বাড়ি যেন পানির ওপর ভাসছে। নৌকা, কলাগাছের ভেলা ছাড়া ঘরবাড়ি থেকে বের হওয়ার উপায় নেই।

কাউয়াদিঘি হাওরের পানি কিছুটা কমে। তাতে পানিবন্দী মানুষের বুকে আশা জাগে এই বুঝি ঘর, উঠান বা রাস্তা থেকে পানি নামবে। কিন্তু গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পানি বাড়ায় কাউয়াদিঘি হাওরপারের পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বাণী রানি বিশ্বাসদের বাড়িতে পাশাপাশি চারটি ঘর। প্রতিটি ঘরেই এখন হাঁটুপানি। সামান্য একটু উঁচু স্থানে দেখা গেল, দুই নারী ঢোল-কলমির শুকনো ডাঁটা জড়ো করে কাটাছেঁড়া করছেন। এগুলো রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করবেন।

বাণী রানি বিশ্বাসের প্রতিবেশীগনেশ সরকার বলেন, ‘দুই মাস ধরি অউরকম (এ রকম) আছি। নাও নাই। কলার ভুরা (ভেলা) দিয়া চলাচল করি। সবচেয়ে বেশি সমস্যা টয়লেটের। রাইত নৌকায় গিয়া টয়লেট করতে অয় (হয়)। মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ। ঘরে এর আগে আর কোনো দিন পানি উঠছে না।’

ঘরের ভেতর মাচার ওপর শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছেন কার্তিক সরকার। ঘরের বাইরে লোকজনের কথাবার্তা শুনে কচুরিপানা দিয়ে উঁচু করা পা ফেলার মতো এক টুকরো স্থানে বেরিয়ে আসেন কার্তিক।বলেন, এই পানির কবল থেকে তাঁরা কিছুতেই নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না। তাঁরা জানালেন, বোরো ফসল পানিতে নষ্ট হওয়ায় ঘরে খাবার নেই। কোথাও কাজের সুযোগ নেই। এ পর্যন্ত তাঁদের বাড়ির চারটি পরিবার সরকারিভাবে ১ হাজার ৮০০ টাকা করে এবং বেসরকারিভাবে কিছু চাল পেয়েছে।

বড়বাড়ি গ্রামের স্বপ্না রানি বিশ্বাসদের উঠানে পানি। ঘরের বারান্দায় নৌকা। তখন নৌকা নিয়ে একটি শিশু বাড়ির বাইরে যাচ্ছিল।স্বপ্না রানি বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাস ধরি আমরা পানির মাঝে আছি। গরু-বাছুর একখানো থাকরাম। গরু রাখার জায়গা নাই। বাড়ির পুরুষ মানুষরা মাছ ধরইন (ধরেন)। খাওয়ার বুঝ দুই-আড়াই শ টাকার মাছ পাইন। মাছ বেচিয়া কোনো রকম চলরাম। সরকারি কেউ আমরার এদিকে আইছইন না (আসেননি)। কেমনে থাকতাম। কেমনে চলতাম।’ তিনি (স্বপ্না রানি বিশ্বাস) জানান, প্রায় তিন সপ্তাহ আগে বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে তাঁরা পাঁচ কেজি চাল পেয়েছিলেন।

একই গ্রামের চিত্ত সরকারের ঘরে পানি উঠেছে। প্রথম দিকে বাড়িতে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একপর্যায়ে আর থাকা সম্ভব হয়নি। বড়বাড়ি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গায় টিনের ছাপরা তৈরি করে মাসখানেক ধরে পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে আছেন। তিনি জানালেন, একবার সরকারিভাবে ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং একবার বেসরকারিভাবে চিড়া-চাল পেয়েছিলেন।

মানিকনগর গ্রামের কবির মিয়া (৫০) বলেন, ‘খাওয়াইতাম (খাওয়াতে) পারি না দেখি তিনটা গরু কম দামে বেচছি। খের (খড়) আছিল পানিয়ে পচি গেছে। পানির কারণে চলাফেরা করার অবস্থা নাই। কেউরে খের দেওয়ার কথা কইলে কইব (বলে) ভাত চাইরটা নিয়া খাইলা। খের দিতাম পারতামনায়। ঈদের সময় গরু বেচলে গোটা ৫০-৬০ হাজার টাকা করি পাইলামনে। বেচছি ৩৫-৪০ হাজার করি।’ এ রকম আরও অনেকেই পানির কারণে লালনপালন করতে না পেরে কম দামে গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

একাটুনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আফজাল হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের বড়বাড়ি, কানিয়া, বাঙাল কানিয়া, মানিকনগরে দুই মাস ধরে প্রায় ২০০ পরিবার পানিবন্দী। এদের পেশা কৃষি ও মাছ ধরা। ধান তো পানিয়ে নিয়ে গেছে। মাছও পর্যাপ্ত মিলছে না। এরা খুব কষ্টে আছে।’ ইউপি সদস্য জানিয়েছেন, সরকারিভাবে তার এলাকায় এখন ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে না। তবে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে পানিবন্দী মানুষকে সহায়তা করা হচ্ছে। গত সোমবার তাঁর ওয়ার্ডের জন্য ৫০০ কেজি চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইকবাল হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এগুলো বিতরণ করা হবে।