ভর্তি জালিয়াতি থামছে না

ভর্তি জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে দুই শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাঁদের একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সহসম্পাদক। জালিয়াতির ঘটনায় মামলা হওয়ার পর গতকাল শুক্রবার দুজনকেই সাময়িকভাবে বহিষ্কারের কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায় গতকাল বিকেলে আটজনকে আটক করে পুলিশ। সন্ধ্যায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাঁদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।

এর আগে ১৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায়  ছাত্রলীগের দুই নেতাসহ আটক করা হয় ১৫ জনকে।

গত বৃহস্পতিবার থেকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর আগের দিন বুধবার সকালে চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের নতুনপাড়া এলাকা থেকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাজমুল কবিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর কাছ থেকে ভর্তি-ইচ্ছুক ৩০ শিক্ষার্থীর নাম ও মুঠোফোন নম্বর, তিনটি ব্লুটুথ ইয়ার ফোন, ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতো দেখতে দুটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস (এর মধ্যে মুঠোফোনের সিম ব্যবহার করা যায়) উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে নাজমুল স্বীকার করেন, ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার দিন ওই ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও ব্লুটুথের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়ার চুক্তি করেছিলেন তিনি। এ জন্য সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা (জনপ্রতি) তাঁকে দেওয়ার কথা ছিল। তাঁর সঙ্গে এই কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন জড়িত। নাজমুলের তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের বাদুরতলা এলাকার একটি বাসা থেকে ছাত্রলীগ নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ইসতিয়াক আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বাসায় বরিশাল থেকে আসা ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী রফিউজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে আরও দুটি এটিএম কার্ডসদৃশ ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। গতকাল ওই শিক্ষার্থীর ‘ঘ’ ইউনিটে (সমাজবিজ্ঞান অনুষদ) পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবছার উদ্দিন বাদী হয়ে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে অবৈধভাবে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও ব্লুটুথের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর লিখতে সাহায্য করার অভিযোগে মামলা করেন।

পুলিশ জানায়, জালিয়াত চক্রের কিছু সদস্যও পরীক্ষায় অংশ নেয়। মূলত তাদের কাজ থাকে কোনোভাবে প্রশ্নের ছবি মুঠোফোনে তুলে তা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া। পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে থাকে চক্রের অন্য সদস্যরা। তাদের মধ্যে মেধাবী শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। প্রশ্ন পাওয়ার পর চক্রের সদস্যরা চুক্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেয়। এসব করতে কিছু সময় লাগে। ততক্ষণ কোনো শিক্ষার্থী বসে থাকলে শিক্ষকেরা যাতে সন্দেহ করতে না পারেন, সে জন্য একটি বিশেষ কলম ব্যবহার করে তারা। প্রথমে ওই কলম দিয়ে বৃত্ত ভরাট করেন। সঠিক উত্তরটি পাওয়ার পর কলমের পেছনের অংশ দিয়ে আগে ভরাট করা বৃত্ত সহজেই মুছে ফেলা যায়। পরে সঠিক উত্তরটি ভরাট করা হয়।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (পাঁচলাইশ অঞ্চল) এস এম মোবাশ্বের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষাকেন্দ্রে তল্লাশি করার সময় ওই ডিভাইসকে সহজেই এটিএম কার্ড বলে পার পাওয়া সম্ভব।

গতকাল দুপুরে বায়েজিদ বোস্তামী থানা কার্যালয়ে গ্রেপ্তার ইসতিয়াক ও রফিউজ্জামানের কাছে জালিয়াতির সঙ্গে আর কারা জড়িত, জানতে চাইলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ইসতিয়াক ও রফিউজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আদালতে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছেন তাঁরা। আদালতে তাঁদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।

এদিকে কাল রোববার দুই শিক্ষার্থীর রিমান্ডের শুনানি হতে পারে বলে জানান চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী। বুধবার গ্রেপ্তার করা শিক্ষাথীকে আগেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, দুই শিক্ষার্থীকে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন তাঁরা।

এদিকে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায়ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতি হয়েছে বলে জানান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রাজ্জাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রের বাইরে থেকে ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষার্থীদের সহায়তা করা হচ্ছে—এমন তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালান। শহরের গোলাপবাগের একটি দোকান এবং আবদুল হামিদ সড়কের একটি হোটেল থেকে এটিএম কার্ডের মতো দেখতে তিনটি ডিভাইসসহ আটজনকে আটক করেন তাঁরা। তাঁরা সবাই বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী হাকিম আটজনের মধ্যে দুজনকে দুই বছর করে এবং অন্যদের এক মাস করে কারাদণ্ড দেন।