যেভাবে ফাঁস হলো প্রশ্ন ফাঁসের খবর

আগের দিন বিকেলে খবর পেলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে পরীক্ষা শুরুর আগে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা অনেকে জড়ো হন। সেখানে তাঁরা বুয়েটের ‘বড় ভাইদের’ কাছ থেকে সাজেশন নিতে আসেন। বলছি গত মে মাসের ১৩ তারিখের কথা। খটকা লাগল, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে সকালে পরীক্ষার্থীরা কেন সেখানে জড়ো হবেন! বিষয়টির খোঁজ দিয়েছেন বুয়েটেরই এক শিক্ষার্থী। তিনি বলছিলেন, ‘ভাই, পোলাপান সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যাদের কাছে তারা প্রাইভেট পড়ে, সকালে ওদের কাছে প্রশ্ন নিয়ে চলে আসে। প্রশ্নের সমাধান করে দিতে বলে। ওই সমাধান নিয়ে তারা পরীক্ষা দিতে যায়। আমার ক্যাম্পাস আমার কাছে পবিত্র একটা জায়গা। এখানে বসে তারা এসব করবে, আমাদের কি কিছুই করার নাই?’
আমি বললাম, পুলিশ বা প্রশাসন কাউকে জানিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘আগের বছর জানিয়েছিলাম। আগের রাতে প্রশ্ন পেয়ে আমরা দুবার শিক্ষা বোর্ডে মেইল করেছি। একবার জানানো হলো, এটা সঠিক প্রশ্ন না। আরেকবার জবাব আসছে, গুজব ছড়াবেন না। গুজব ছড়ালে আপনাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে।’
কথাটা যিনি বললেন, তিনিও হাসলেন। আমিও হাসলাম। কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারি, এটা কত ভয়ংকর একটা দৃশ্য! অফিসে গেলে প্রধান প্রতিবেদক টিপু সুলতান বললেন, ‘বুয়েটে নাকি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পোলাপান ঘোরাফেরা করে। একটু খবর নেন।’ কীভাবে কাজ করতে হবে, তিনি পরামর্শ দিলেন আর সঙ্গে দিলেন প্রথম আলোর আলোকচিত্রী হাসান রাজাকে।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে এক বন্ধুকে নিয়ে হাজির হলাম বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে। আমাদের সংবাদের ‘সোর্স’ তখন পর্যন্ত আসেননি। তাঁকে বলেছিলাম বুয়েটেরই কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে উপস্থিত হতে। শহীদ মিনারের ঠিক পেছনেই দেখছি কয়েকটি মেয়ে বই খুলে তার ভেতরে মুঠোফোন রেখে কী যেন দেখছে আর পড়ছে। আমাদের এখন জানতে হবে তারা কী দেখছে।
হাসান রাজা ভাই এলেন। উপস্থিত হলেন সোর্সও। সোর্স এবং আমার কয়েকজন বন্ধু-ছোট ভাই জড়ো হলো ঘটনাস্থলে। তারা সবাই বুয়েটেরই শিক্ষার্থী। আমাদের পরিকল্পনা হলো—তাদের কাছে কী আছে, সেটা জানতে হবে। নিশ্চয়ই তাদের গিয়ে বললেই দেখাবে না। আমাদের কাজ সংবাদ সংগ্রহ করা। কাউকে জোর করাটাও আমাদের মানায় না। বুয়েটের যারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তাদের বললাম, যেহেতু আপনাদের ক্যাম্পাস, আপনারা জানতে চাইতে পারেন, এখানে তারা কী করছে। আমরা ভিডিও করব। এতে আমাদের কাছে আরও জোরালো প্রমাণ থাকবে।
প্রথমেই গেলাম তিতুমীর হলের অতিথিকক্ষে। সেখানে ছয়জন পরীক্ষার্থীকে প্রশ্নের সমাধান করে দিচ্ছেন একজন বুয়েটের শিক্ষার্থী। একজন খাতায় লিখছিলেন, অন্যরা বই-খাতা খুলে ওই খাতায় নজর রাখছিলেন। জিজ্ঞেস করতেই একে একে সবাই বের হয়ে গেলেন। আমরা তাঁদের আটকে রাখতে পারলাম না। পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হলো। আমাদেরও খানিকটা পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। নইলে প্রমাণ করা কঠিন।
ছাত্রী হলের দিকে যাওয়ার রাস্তায় ঢুকে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কয়েকজন করে পরীক্ষার্থী। সঙ্গে একজন করে প্রশ্ন সমাধানকারী। তারা গাড়িতে বসেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন। গাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছেন পরীক্ষার্থীর মা কিংবা বাবা। পৌনে ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে একই চিত্র। কয়েকজনের মুঠোফোনেও প্রশ্ন আছে, এমন দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করা হলো। পরদিন প্রথম আলোর প্রথম পাতায় খবরটা ছাপা হয়েছিল ‘পরীক্ষার আগে প্রশ্ন সমাধানের আসর!’ শিরোনামে। অনলাইনে খবরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ভিডিওটি।