স্বপ্ন বুননের কারখানা

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভবন। ছবি: প্রথম আলো
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভবন। ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমার প্রথম পদার্পণ খুব নাটকীয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এসএসসি পরীক্ষার পরে আমাদের ক্লাসরুমে এসে বক্তব্য দিলেন, পৃথিবীটা বিরাট এক রসগোল্লা। এই রসগোল্লার স্বাদ নিতে হবে পিঁপড়ার মতো। তখন তিনি টেলিভিশন উপস্থাপনার কারণে খ্যাতির মধ্যগগনে। আমরা এটাও জানতাম তিনি ঢাকা কলেজের শিক্ষক। তবে তার আগেই আমি কেন্দ্রের কথা জানতাম। আমার মায়ের স্কুলজীবনের বান্ধবী মমতাজ খালা ও তাঁর স্বামী ফরিদ খালু হলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের চাচাশ্বশুর। তিনি ছিলেন কেন্দ্রের ট্রাস্টি। আর স্যার ছিলেন আমার প্রিয় উপস্থাপক। সত্তর ও আশির দশকে খুব বেশি বাড়িতে টিভি ছিল না। সৌভাগ্যবশত আমাদের বাড়িতে একটা টেলিভিশন থাকায় আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল টেলিভিশন। আর প্রিয় উপস্থাপক ছিলেন স্যার।
স্যারের রসগোল্লা বক্তৃতার সঙ্গে ছিল বই পড়া প্রতিযোগিতা ও তারপর পরীক্ষায় প্রথম ১০ জনকে ১ হাজার টাকা করে মোট ১০ জনের জন্য ১০ হাজার টাকার বই পাওয়ার প্রলোভন। সেই লোভে ৪০ টাকা দিয়ে কেন্দ্রের লাইব্রেরির সদস্য হলাম। প্রতিযোগিতা শেষে সেই টাকা ফেরত দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন স্যার।
শুরু হলো বই পড়ার প্রতিযোগিতা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন কলেজ থেকে আসা ছেলেমেয়েরা বই পড়ে। তারপর বই নিয়ে হয় আলোচনা। স্যার আসেন। আমাদের বয়সীদের স্বল্প জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে বলা কথা তিনি মনোযোগ দিয়ে শোনেন। একসময় পুরস্কারও পেয়ে গেলাম। তারপরও কেন্দ্রে আসা–যাওয়া বন্ধ হলো না আমার। কী এক অদ্ভুত মায়া আর বই পড়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা প্রতি বেলা কেন্দ্রে নিয়ে যেত আমাকে। বাংলামোটরের মোড়ে বিআরটিসির লাল বাস থামত না। লাফ দিয়ে নামতে হতো। কখনো কখনো ফার্মগেট থেকে হেঁটে চলে আসতাম। কেন্দ্রে দেখা হতো বাংলাদেশের নামকরা সব মানুষের সঙ্গে।
স্যারের প্রিয় ছাত্ররাও আসতেন। লিয়াকত আলী, মিজারুল কায়েস, মিজানুর রহমান, আবদুল বাতেন, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, আহমাদ মাজহার, এঁরা সব আমাদের সঙ্গে বইয়ের আড্ডায় অংশ নিতেন। কেন্দ্র তখন অনেক ছোট। মাত্র বছর কয়েক হলো ইন্দিরা রোডের ভাড়া বাসা থেকে নিজের ঠিকানায় এসেছে। উত্তম সাহার ডিজাইনে কেন্দ্রের সাধারণ ইটের মেটে লালচে রঙের একতলা দালান, আর একটা পুরোনো বাংলো। বাংলোটা লাইব্রেরি। তার পাশে গান শোনার কক্ষ। ওখানে ছিল সবেধন নীলমণি পুরোনো একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্র। আমি ভিনাইল রেকর্ড ঝাড়পোঁছ করার অছিলায় দুপুরে এসি ছেড়ে গান শুনি। স্যার মাঝে মাঝে বৈকালিক বিশ্রাম করেন সেখানে। একটা ইজিচেয়ার ছিল ঘরের একমাত্র আসবাব। আর নানা রকম গানের যন্ত্রের সমাহার। ডেনন, আকাই রেকর্ড প্লেয়ারে গান শোনার মজা আলাদা। আমি সুযোগ পেলেই শুনি। সেখানে পরিচয় হলো মোৎসার্ট, বিটোফেন, রবিশঙ্কর, কেনি রজার্স, জ্য মিশেলের সঙ্গে। শচীন দেবের গান, নিধু বাবুর টপ্পা, ঠুমরি, গজল, গোলাম আলী, আলাউদ্দিন খান, মেহেদী হাসান সবাই বন্ধু হয়ে উঠলেন আমার একলা দুপুর আর শুকনো বিকেলগুলোতে।
আসেন সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুশ শাকুর, শামসুর রাহমানসহ বড় বড় সব লেখক। সুপুরুষ সুদর্শন উপস্থাপক আনিসুল হক, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ আসেন। মাঝে মাঝে আসেন আবেদ খান ও সানজিদা খান। মমতাজউদ্‌দীন আহমদ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে হাস্যরসে ভরে রাখেন সবাইকে। পটুয়া কামরুল হাসানের গল্প শুনি মুগ্ধ হয়ে।
একদল তরুণ সাহিত্যিক আসেন, আবৃত্তিকারেরা আসেন, আসেন কিছু নবীন গানের শিল্পী। কেন্দ্রের ছাদে গরম চা–শিঙাড়ার সঙ্গে জমে ওঠে তার চেয়েও গরম আড্ডা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, কেন্দ্র কখনো খালি নেই সন্ধ্যায়। আমার বন্ধুরা যখন যৌবনের আগমনের সময়টিতে নানা রকমভাবে পুরুষ হয়ে উঠছে, আমি তখন বালকের বিস্ময়ে আবিষ্কার করছি সৃজনশীল মানুষদের সঙ্গে চলার আনন্দ ।
কেন্দ্র ছিল একটা স্বপ্নচাদর বুননের কারখানা। আমি চিনে ফেললাম মায়কোভস্কি, গোগল, রাহুল সাংকৃত্যায়নকে। আহমদ ছফা, আরজ আলী মাতুব্বর সবই পড়া হয়। কিন্তু কেন্দ্র কোনো বিশ্বাস বা আদর্শের প্রচার করে না। কেন্দ্র অনেকটা রেলস্টেশনের মতো। যে যার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সেখানে আসে, কেউ বসে আড্ডা দেয়, কেউ চায়ের দোকানে, কেউ বইয়ের স্টলে। কেন্দ্র কারও গন্তব্য ঠিক করে দেয় না। বিশ্বসাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ধর্ম নিয়ে কেন্দ্র বই হাতে তুলে দেয় কিন্তু কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় না। কেন্দ্র মানুষের অন্তরের শক্তি ও সামর্থ্যে আস্থা রাখে, বিশ্বাস করে মানুষের মধ্যে ভালো আছে, আলো আছে, আছে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা। হৃদয়নিঃসৃত ভালোবাসা ও শুভকর্ম দিয়ে আলোকিত মানুষ হওয়ার কথা।

একনজরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
প্রতিষ্ঠা:
১৯৭৮

প্রতিষ্ঠাতা, সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী: অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
নিয়মিত কর্মী: ৩৭৭ জন
স্বেচ্ছাসেবক: প্রায় ১৫ হাজার
ট্রাস্টি: অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মোহাম্মদ ফরিদউদ্দীন, এ কে এম রফিকউদ্দীন, মাহবুব জামিল, খোন্দকার মো. আসাদুজ্জামান, ড. ইফতেখারুজ্জামান, শাহ আলম সারওয়ার, মনসুর আহমেদ চৌধুরী ও অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেট: ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা
নিবন্ধিত সদস্য (১৯৭৮–২০১৭): ১ কোটি
অন্তর্ভুক্ত স্কুল ও কলেজ: ১৪ হাজার
মূল লাইব্রেরিতে বই: প্রায় ২ লাখ
লাইব্রেরি ব্যবহারকারী: ৫০ হাজার (বছরে)
ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির বই: ৪ লাখ
ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির সদস্য: ৩ লাখ ৫০ হাজার
পুরস্কার: ইউনেসকোর জ্যান অ্যামোস কমিনিয়াস পদক ২০০৮, র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার ২০০৪ (প্রতিষ্ঠাতা)

আবদুন নূর তুষার: চিকিৎসক, টিভি ব্যক্তিত্ব।