ধানের যত উদ্ভাবন

গাজীপুরে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গত সাড়ে চার দশকে ৮৬ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। ছবি: জাহিদুল করিম
গাজীপুরে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গত সাড়ে চার দশকে ৮৬ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। ছবি: জাহিদুল করিম

গল্পটা এমন—ষাটের দশকে এ দেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ কোটির কাছাকাছি। কিন্তু অভাব ছিল সীমাহীন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। মুরব্বিদের কাছে শুনেছি, তখন সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষ ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক পেয়ালা ভাতের মাড়ের জন্য বিত্তবানদের কাছে ধরনা দিত। এমন এক পরিস্থিতিতে তৎকালীন কৃষি কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির স্বাধীনতাসংগ্রাম যখন শুরু হলো, তখন মানুষের অন্ন-বস্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলো স্লোগানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্লোগান ছিল, ‘বাংলার প্রতি ঘর, ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে’। এই স্লোগান তখন কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেছিল। বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু তাই সর্বপ্রথম সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি সবুজ বিপ্লবের কথা বলতে।’ একই ভাষণে তাঁর আরেকটি উক্তি: ‘দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাউল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের চাউল পয়দা করে খেতে হবে।’ এতেই বোঝা যায় তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে খাদ্য বা ধানের নিরাপত্তাই এ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান উপায়।

আবহমানকাল ধরে ধানকে এ দেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বাংলাদেশে খাদ্যের নিরাপত্তা বলতে মূলত ধান বা চালের নিরাপত্তাকেই বোঝায়। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর পত্রিকা ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছে, অতীতের তীব্র খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনীতির নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, যা সম্ভব হয়েছে কেবল চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বা খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে।
মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য। আর বাংলাদেশের ৯০ ভাগ লোকের প্রধান খাবার ভাত। কোনো দেশের শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি—সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এই খাদ্যের নিরাপত্তা দিয়ে। দেশের জনসংখ্যা যখন ১৬ কোটি, তখন এত মানুষের খাবারের জোগান দেওয়া সহজ কথা নয়। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই বিশাল চ্যালেঞ্জই ৪৭ বছর ধরে মোকাবিলা করে যাচ্ছেন এ দেশের ধান বিজ্ঞানীরা।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই দেশের কৃষি-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রবর্তন করা হলো উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাত আইআর৮। ব্রির বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করলেন, তিন মৌসুমে চাষের উপযোগী উফশী ধানের আধুনিক জাত বিআর৩, যা বিপ্লব ধান নামে ব্যাপক পরিচিতি পায় এবং সত্যিকার অর্থেই জাতটি দেশের ধান উৎপাদনে বিপ্লবের সূচনা করে। আইআর৮ ও বিপ্লব এ দুটি উফশী জাত প্রবর্তন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে মূলত আধুনিক ধান চাষের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর ঘোষিত সবুজ বিপ্লব কর্মসূচিও থমকে যায়। আমরা ধীরে ধীরে পরিণত হই বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর জাতিতে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারে এলে পিতার সবুজ বিপ্লবের ধারণা নতুন করে প্রাণ পায়। শুরু হয় খাদ্য উৎপাদনে নতুন এক অধ্যায়। সার, বীজ ও কৃষি উপকরণে প্রণোদনা কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে দানা শস্যে স্বয়ম্ভরতাসহ কৃষি খাতে একের পর এক সাফল্য পায় বাংলাদেশ, যার অন্যতম প্রধান সহযোগী বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)।
১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে ব্রি এ দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান, শীতপ্রধান অঞ্চলের উপযোগী ধান, সরু ও সুগন্ধি প্রিমিয়াম কোয়ালিটি ধান, জিংক-সমৃদ্ধ ধান (বিশ্বে প্রথম), হাইব্রিড ধানসহ গত ৪৭ বছরে ৮০টি ইনব্রিড ও ৬টি হাইব্রিড মিলিয়ে ৮৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। গত চার দশকে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। ১৯৭০-৭১ সালে এ দেশে চালের উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন। ৪৭ বছরের ব্যবধানে আজ ২০১৭ সালে এসে দেশে যখন জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, তখন চাল উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টনের বেশি। যে জমিতে আগে হেক্টরপ্রতি ২-৩ টন ফলন হতো, এখন উফশী জাতের ব্যবহারের কারণে ফলন হচ্ছে ৬-৮ টন।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ব্রি পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা খাদ্য নিরাপত্তায় এর অবদানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, অতীতের তলাবিহীন ঝুড়ি কীভাবে উদীয়মান অর্থনীতির নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলো, সে প্রশ্নের উত্তর তিনি পেয়েছেন ব্রিতে এসে।
বর্তমান স্বয়ংসম্পূর্ণতা বা উদ্বৃত্ত উৎপাদন এক দিনে অর্জিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, দেশের ধান বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি এ দেশের মেহনতি কৃষকদের নিরলস পরিশ্রম।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উৎপাদন গতিশীলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭২ লাখ টন। বিপরীতে ২০৫০ সালে ২১ কোটি ৫৪ লাখ লোকের খাদ্যচাহিদা পূরণে চাল প্রয়োজন হবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। অর্থাৎ, গত পাঁচ বছরের চালের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দেশে ২৬ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এটাই আপাতত টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্য, যা সামনে রেখে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা।
ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বোরো মৌসুমে সর্বাধিক ফলন ও কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয় জাত ব্রি২৮ এবং ব্রি২৯। অনুরূপভাবে আমন মৌসুমে সফলতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে বিআর১১ জাতটি। বিজ্ঞানীরা এই জাতগুলোকে বলেন মেগা ভ্যারাইটি (বহুল ব্যবহৃত জাত)। সময়ের চাহিদার প্রেক্ষাপটে পরবর্তী সময়ে এই জাতগুলোর পরিপূরক অনেক জাত যেমন বোরো মৌসুমে ব্রি৫০, ৫৮, ৫৯, আউশে ব্রি৪৮, আমন মৌসুমে ব্রি৪৯ ও ৬২ উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সেগুলো মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশ্বের সর্বপ্রথম জিংক-সমৃদ্ধ ধানের জাত ব্রি৬২, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ ধান বিআর৫, ডায়বেটিক ধানের জাত বিআর১৬ ও ২৫ উদ্ভাবন এবং প্রো-ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইসের জাত উন্নয়ন করে সারা বিশ্বের সুনাম অর্জন করেছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা।
১৯৯৭ সালে রোপা আমন ধানের স্বল্প জীবনকালের জাত ব্রি৩৩ উদ্ভাবন করে দেশের উত্তরাঞ্চলের (বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর) মরা কার্তিককে ভরা কার্তিকে রূপান্তর করা হয়েছে। ওই সব এলাকায় মঙ্গাজনিত মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে ব্রি৩৩সহ স্বল্প জীবনকালের জাত ব্রি৫৬, ৫৭, ৬২, ৬৭, ৭১ ও ৭৫। এই জাতগুলোর গড় জীবনকাল ১০০ দিন বা এর কাছাকাছি। ফলে আগাম ধান তুলে কৃষকেরা একই জমিতে পর্যায়ক্রমে একাধিক ফসল চাষ করতে পারেন। ফসলের জীবনকাল কমিয়ে আনার মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক স্থানীয় জনগণের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ব্রির এই সাফল্য অন্যতম মাইলফলক।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রির গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল অল্প জমি থেকে বেশি পরিমাণ ধান উৎপাদন করা। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মেটানোই ছিল তখনকার মূল লক্ষ্য। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেই সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও রুচির পরিবর্তন এসেছে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরু-সুগন্ধি এবং রপ্তানির উপযোগী প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। ধান গবেষণায় যুগান্তকারী সাফল্যের কারণে অনেকে ব্রিকে একটি অন্নদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ধান, রক্তশূন্যতা ও ডায়রিয়া রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী প্রায় ২০ থেকে ২৪ পিপিএম জিংক-সমৃদ্ধ ব্রি৬২, ৬৪, ৭২ ও ৭৪ অবমুক্ত করার ফলে এখন পুষ্টিদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবেও স্বীকৃতি লাভ করছে ব্রি।
ধান গবেষণায় ব্রির সাফল্য দেশের সীমা ছাড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। আমাদের উদ্ভাবিত ধানের জাত বিদেশেও আবাদ হচ্ছে। বেশ কিছু দেশে যেমন ভারত, নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, চীন, কেনিয়া, ইরাক, ঘানা, গাম্বিয়া, বুরুন্ডি, সিয়েরা লিওনসহ অনেক দেশ ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ধানের জাত ব্যবহার করছে। পৃথিবীর ১৪টি দেশে বর্তমানে ১৯ জাতের ব্রি ধানের আবাদ হচ্ছে। বিজ্ঞান ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রি তিনবার স্বাধীনতা দিবস স্বর্ণপদক এবং তিনবার রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক, দুবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ২১টি পুরস্কার লাভ করেছে। দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ব্রির সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত থাকুক সেই কামনা সংশ্লিষ্ট সবার।

শাহজাহান কিবরিয়া
মহাপরিচালক, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।