অনন্য সহমর্মিতা

সারা বিশ্ব যখন বিপন্ন শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে সাধারণভাবে অপারগ, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরণার্থী-সংক্রান্ত ১৯৫১ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সেটার মর্মার্থকে লঙ্ঘন করছে, তখন ২৫ আগস্ট ২০১৭ তারিখের পর থেকে আসা ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীকে গ্রহণ করে বাংলাদেশ এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় যে পশ্চিমা বিশ্ব নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের ভাষায় ‘লোহার বেড়াজাল’ থেকে পালিয়ে আসার জন্য পূর্ব ইউরোপীয়দের উদ্বুদ্ধ করত এবং আশ্রয়প্রার্থীদের নানা ধরনের সুযোগ দিতে কার্পণ্য করত না, সেই পশ্চিমা বিশ্বই ঠান্ডা লড়াই-পরবর্তী পর্যায়ে শরণার্থীদের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যুদ্ধ, নিগ্রহ ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য শরণার্থীরা যেন পশ্চিমা বিশ্বে আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য প্রবেশ করতে না পারে, তার জন্য তারা ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধের অদৃশ্য বেড়াজাল সৃষ্টি করে।
শরণার্থী স্বার্থবিরোধী তাদের এই অবস্থান নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। ক্রমেই আমরা দেখতে পাই, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ শরণার্থী প্রবেশ বন্ধ করতে কাঁটাতারের বেড়াসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীবাহী নৌযান ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগান বা সোমালিয়ার আশ্রয়প্রার্থীদের নৌযানগুলোকে সে দেশে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে এবং দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থার অধীনে পাপুয়া নিউগিনি ও নাউরুতে শরণার্থীদের আটকে রাখার নীতি গ্রহণ করছে। বেশির ভাগ পশ্চিমা রাষ্ট্র শরণার্থী বহনকারী বিমান কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ চড়া জরিমানার ব্যবস্থা করেছে। কোনো কোনো দেশ উৎস দেশে ফিরে গেলে জীবনের ওপর হুমকি থাকা সত্ত্বেও প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে শরণার্থীদের সেসব দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে এবং একই সঙ্গে শিথিল করার পরিবর্তে শরণ লাভের আইনি এবং প্রশাসনিক কাঠামো আরও জোরদার করছে।
মোটকথা, ঠান্ডা লড়াই-পরবর্তী সময়ে কানাডা, জার্মানি ও অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রমী দেশ ছাড়া সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বই যেন শরণার্থীদের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, শরণার্থীবিরোধী এই অবস্থান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও তার ছায়া ফেলেছে। এর ফলে ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ, যারা অতীতে শরণার্থীদের বিষয়ে সংবেদনশীল ছিল, তারা ক্রমেই এ জনগোষ্ঠীর প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে।
সেদিক থেকে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের এই সহমর্মিতা ও মানবিক আচরণ বিশ্বের বিবেকবান ও মানবতাবাদীদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশের এই বলিষ্ঠ ভূমিকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শরণার্থী নিরাপত্তা বিধানে দেশটিকে বিশেষ সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে প্রাথমিকভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। ফলে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা এ দেশে আশ্রয়ের সুযোগ পায়।
এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনো সহজ বিষয় ছিল না। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশেগুলোর অন্যতম। মানব উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে বিশেষ অগ্রগতি অর্জন করলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো এমন কোনো শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি যে আমাদের পক্ষে হঠাৎ করে আসা এত বাড়তি জনসংখ্যার চাপ গ্রহণ করা সম্ভব।
বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, শরণার্থী-অধ্যুষিত কক্সবাজার-উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে আসা শরণার্থীদের চাপ এই অঞ্চলকেই অব্যাহতভাবে বহন করতে হয়েছে। সেই বিবেচনাতেও পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে গড়ে এক লাখ করে শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এ অঞ্চলবাসী এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তের আগেই উখিয়া-টেকনাফবাসী নির্যাতিত, নিঃস্ব, আশ্রয়হীন শরণার্থীদের জন্য ২৫ আগস্ট থেকেই তাদের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। প্রাথমিকভাবে আশ্রয়প্রার্থীরা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে ঠাঁই নিলেও এত বিপুলসংখ্যক অপ্রত্যাশিত অতিথির চাপে এলাকাবাসীর নিয়মিত জীবনযাত্রা বিশেষভাবে ব্যাহত হয়।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সময় ঈদের ছুটি হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা শুরু এবং বেগবান হতে আরও কয়েক দিন পার হয়ে যায়। মানবিকতার তাগিদেই কারও জন্য অপেক্ষা না করে উখিয়া-টেকনাফবাসী তাদের নিজেদের খাবার শরণার্থীদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছে, নিজেদের বসতবাড়িতে, উঠানে ও জমিতে তাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাদের রান্নাঘর ও বাথরুম ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে এবং ধৈর্যের সঙ্গে শুনেছে আশ্রিত ব্যক্তিরা কীভাবে হত্যা, নিগ্রহ ও ধ্বংসলীলার শিকার হয়েছে।
উখিয়া-টেকনাফবাসীর এই দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তি ও সংগঠন। সাধ্যমতো তারা নিজ নিজ এলাকা থেকে ব্যক্তি, স্কুল-কলেজ, ক্লাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা-মসজিদ-মন্দির-গির্জা থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এসেছে আশ্রিত লোকজনের মধ্যে বিতরণের জন্য। এ ক্ষেত্রে আশ্রিত ব্যক্তিদের সুপেয় পানি সরবরাহে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীরা পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পরে বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক সামাজিক ও বেসরকারি সংস্থা ত্রাণ বিতরণে উখিয়া-টেকনাফবাসীর প্রয়াসকে আরও জোরদার করে।
আশ্রিত ব্যক্তিদের থাকার জায়গার ব্যবস্থার জন্য বনভূমিসহ খাসজমির পাশাপাশি টেকনাফ-উখিয়ার অনেক পরিবার তাদের আবাদি জমি অথবা সরকার থেকে লিজ নেওয়া জমিতে বিভিন্ন বয়সী গাছ কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। কারও কারও ফসলভরা খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের ফলে।
এত বিপুলসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থীর আগমন ওই অঞ্চলের শ্রমবাজারের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জীবন রক্ষার তাগিদে আশ্রয়প্রার্থীদের একাংশ সমুদ্রে পোনা ধরা, রিকশা চালানো বা দিনমজুর হিসেবে নির্মাণশিল্প বা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরাসহ বিভিন্ন খাতে স্বল্প দামে নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে যখন আগ্রহী, তখন তা স্বাভাবিক কারণেই উখিয়া-টেকনাফের দরিদ্র শ্রমজীবীদের জীবিকা ও আয়ের মাত্রার ওপর বড় ধরনের হুমকি বয়ে এনেছে। একই সঙ্গে খাদ্যপণ্যের রাতারাতি বিপুল চাহিদা বৃদ্ধি এবং সেই অনুপাতে জোগান না বাড়ায় শাকসবজিসহ সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীর দাম বড় অঙ্কে বেড়ে গিয়ে এলাকাবাসীকে নাকাল করেছে। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা বৃদ্ধির কারণে যেমন বেড়েছে যাতায়াত ব্যয়, তেমনি বেড়েছে ভ্যান ও ট্রাক ভাড়া। বিভিন্ন পর্যায়ের ত্রাণকর্মীদের আগমন ওই অঞ্চলের বাড়ি ও অফিস ভাড়ার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এলাকাবাসী আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করে, এত বিপুলসংখ্যক নিগ্রহের শিকার জনগোষ্ঠীর সঠিকভাবে দেখভালে যদি ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে সঙ্গিন অবস্থায় থাকা এদের একাংশ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্র দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের দাবি তুলেছে। এই সমস্যার একটি ধর্মীয় দিক থাকায় কক্সবাজার-টেকনাফ-উখিয়ার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাখাইন জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতা প্রকট হয়ে উঠেছে। এলাকার এবং জাতীয় পর্যায়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের নেতারা আরাকানে রোহিঙ্গা গণহত্যার চরম নিন্দা জানিয়েছেন। বার্মা সরকারের এ ধরনের আচরণ যে গৌতম বুদ্ধের আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী, তা তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
প্রায় সাড়ে ছয় শ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উখিয়া-টেকনাফের পাঁচ লাখ অধিবাসী এখন নিজ এলাকায় আশ্রিত ব্যক্তিদের তুলনায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান চায়। মানবতার তাগিদে তারা আশ্রয় প্রদানে এগিয়ে এসেছে ঠিকই, তবে এই বাড়তি চাপ মোকাবিলায় তারা যে হিমশিম খাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করার যে দাবি তারা উত্থাপন করেছে, তার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে।
বিপন্ন মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে গৌরবজনক এক অবস্থানে আসীন হয়েছে বাংলাদেশ। এই গৌরব অর্জনে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করে চলেছে উখিয়া-টেকনাফের জনগণ।
জয়তু উখিয়া-টেকনাফবাসী।

সি আর আবরার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সমন্বয়ক।